সরু রাস্তাতেই বাসের আনাগোনা। গোপালগঞ্জ বাজার।
দৃশ্য ১: সঙ্কীর্ণ রাস্তা। মুখোমুখী দু’টি বাস। কে আগে যাবে তা নিয়ে জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে তুমুল তর্কাতর্কি চলল দুই বাস চালকের। পিছনে সারি সারি দাঁড়িয়ে গেল আরও কয়েকটি গাড়ি। বিষ্ণুপুরের মাড়ুইবাজারে এটাই রোজকার ছবি। সপ্তান্তে ছুটি কাটাতে আসা মানুষজনের গাড়ি বেড়ে যাওয়ায় এই সঙ্কট চরম আকার নেয়। কলকাতার দিক থেকে গাড়িগুলি শহরে ঢোকে কাটানধার দিয়ে মাড়ুইবাজার হয়ে চকবাজার যাওয়ার প্রধান রাস্তায়। কিছু বাসের বের হওয়ার পথও ওই রাস্তাই। কিন্তু মাড়ুইবাজারের কাছে রাস্তা এমন সংকীর্ণ যে সামনের-পিছনের দুই বাস পার হওয়া মুশকিল।
ক’দিন আগে দেখা গেল একটি ভলবো ট্যুরিস্ট বাস ও তারকেশ্বরগামী একটি বাস মুখোমুখী দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুই বাসের চালক ও যাত্রীদের মধ্যে কিছুক্ষণ চলল তর্কাতর্কি। শেষ পর্যন্ত ট্যুরিস্ট বাসটিকে অনেকটা পিছিয়ে গিয়ে তারকেশ্বরগামী বাসটিকে পেরিয়ে যাওয়ার জায়গা দিতে হল। ওই ট্যুরিস্ট বাসের চালক সুশান্ত রায় বললেন, “বিষ্ণুপুরে ঢোকা ও বের হওয়ার সময় এই এক হ্যাপা। এই মাড়ুইবাজারে জট কাটল তো চকবাজারে শুরু হল। আবার সেখান থেকে কিছু এগিয়ে মুটুকগঞ্জে ঢুকে একই দশা। সেখানেও রাস্তা সরু। এ ভাবেই চলে।’’ একরাশ ক্ষোভ ঝরে পড়ল চালকের গলায়।
অকেজো হয়ে পড়ে সিগন্যাল রুম। ঝাপর তলায়।
দৃশ্য ২: বোলতলা মোড়ের তেমাথা। সোনামুখী-পাত্রসায়র-বর্ধমান রুটের সব বাসই এই পথে শহরে ঢোকে এবং বের হয়। অনেক ছোট-বড় গাড়িও চলাচল করে ওই পথে। ফলে এখানেও মুখোমুখী গাড়ির যানজট নিত্যদিনের ঘটনা। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ যাওয়ার সময় হেঁটে বা সাইকেলে আসা ছাত্রছাত্রীরা বেজায় সমস্যায় পড়ে। ভুক্তভোগী রামানন্দ কলেজের ছাত্র সৌমিত্র দাস বলেন, “তেমাথায় একজন মাত্র ট্রাফিক পুলিশ। তিনি সামলাতে পারেন না। ফলে যানজটের জন্য কলেজে ঢুকতে দেরি হয়।” স্কুল ছাত্রী রূপা নন্দীর অভিজ্ঞতাও একই। তার কথায়, “সাইকেলে স্কুলে যাই। কিন্তু ওই জয়গাটা পের হতেই রোজ যত ঝামেলা।”
দৃশ্য ৩: রসিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে গোপালগঞ্জ বাজার হয়ে বোলতলার রাস্তা ‘ওয়ান ওয়ে’। বাস্তবে অবশ্য কেউ মানেন না। বিশেষ করে বৈলাপাড়ার দিক থেকে আসা গাড়ি এই পথে ঢুকে প্রায়ই জট পাকায়। গোপালগঞ্জের বাজারের সরু বাঁকও যানজটের অন্যতম কারণ। বাজারে আসা স্থানীয় বাসিন্দা সুদীপ দে বললেন, “ওয়ান ওয়ে হলেও কেউ মানেন না। এ দিক ও দিক থেকে গাড়ি ঢুকে পড়ে। ট্রাফিক পুলিশেরও নজরদারি নেই। ফলে রোজদিনের যানজট এখানে।”
এর থেকে কি মুক্তি মিলবে না? বাসিন্দাদের এই ক্ষোভের আঁচ অনেক দিন আগেই টের পেয়েছে পুলিশ। এই শহরেরই এক বাসিন্দা জেলা পুলিশের ওয়েবসাইটে ট্রাফিক সমস্যার কথা জানিয়েছিলেন। পুলিশ সুপার আশ্বাসও দেন। বিষ্ণুপুর থানার আইসি স্বপন দত্ত বলেন, “যানজট কাটাতে আমরা বিষ্ণুপুর শহরের পাঁচটি পয়েন্ট বাসস্ট্যান্ড, চকবাজার, বোলতলা, রবীন্দ্র স্ট্যাচু ও বিষ্ণুপুর-সোনামুখী মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ দিয়েছি।” কিন্তু তাও যে পর্যাপ্ত নয়, তা নিত্যদিনের ভোগান্তিই জানান দিচ্ছে। মহকুমাশাসক (বিষ্ণুপুর) পলাশ সেনগুপ্ত বলেন, “পুরসভার সঙ্গে যানজট নিয়ে এক প্রস্ত আলোচনা হয়েছে। যানজট কাটাতে আর কী করা যায়, তা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা চলছে।”
শহরের বাসিন্দাদের অনেকেই অবশ্য যানজট কাটাতে বিকল্প রাস্তার কথা ভাবার পরামর্শ দিচ্ছে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের। তাঁদের মতে, এমআইটি কলেজ মোড় থেকে তুড়কিরডাঙা পর্যন্ত হয় পাকা রাস্তা চাই, না হলে ফ্লাইওভার। তবেই মিলতে পারে সমাধানসূত্র। বিষ্ণুপুরে বেড়াতে আসা কলকাতার এক পর্যটক কাজল চক্রবর্তী বলছিলেন, “রাস্তাঘাট ঠিকঠাক থাকলে এই শহরের উন্নয়নের প্রচুর সম্ভাবনা আছে। কারণ এখানকার ঐতিহাসিক নিদর্শন ও হস্তশিল্পগুলি তো পৃথিবী বিখ্যাত।”
তার টানেই বহু বিদেশী পর্যটকও বিষ্ণুপুরে আসেন। কিন্তু বাংলার প্রাচীন এই জনপদের রাস্তা অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। চাই নতুন কিছু। বেশ কিছুকাল আগে এই শহরের পাশ দিয়ে বাইপাস হয়েছে। কলকাতার থেকে বাঁকুড়ার দিকে যাওয়া ভারী মালপত্র বহনকারী গাড়ি ওই পথে চালে। ফলে কিছুটা হলেও চাপ কমেছে শহরের ভিতরের রাস্তাগুলির। কিন্তু শহরের জনসংখ্যাও তো বাড়ছে। তেমনই বাড়ছে পর্যটকদের আনাগোনাও। তাই বাসিন্দারা চাইছেন, কলকাতার দিক থেকে আসা দৈনন্দিন যাত্রিবাহী ও ট্যুরিস্ট বাসগুলি নতুন পথ ধরে বিষ্ণুপুরে ঢুকুক। তা হলে জট অনেকটাই কাটবে। তবে বাসিন্দাদের মনে কথা বোধহয় প্রশাসনের কান পর্যন্ত পৌঁছেছে।
তাই মন্ত্রী তথা বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা যানজট সমস্যা কাটাতে ইতিমধ্যেই কিছু পরিকল্পনা নিয়েছি। যার মধ্যে রয়েছে এমআইটি মোড় থেকে তুড়কিরডাঙার কাছাকাছি পর্যন্ত একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ। এ জন্য বিভিন্ন স্তরে আলোচনা চলছে।”
— শুভ্র মিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy