মাসের পয়লা তারিখ। নোটের আকালে ব্যাঙ্কে যে ভুগতে হবে গত কয়েক দিনের অভিজ্ঞতায় বুঝে গিয়েছেন গ্রাহকরা। বৃহস্পতিবার জেলাজুড়ে মিলল তারই খণ্ডচিত্র।
পেনশন ভোগী থেকে চাকুরিজীবী সকলেই এ দিন ব্যাঙ্কে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। টাকা নিয়ে টালমাটাল পরিস্থিতি, তাতে এ দিন খুব বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হবে এটাই ধারণা করেছিলেন অনেকে। তবে, ছবিটা এ দিন কিছুটা ভাল। বিশেষ করে পেনশনভোগীদের জন্য অধিকাংশ ব্যাঙ্কেই পৃথক ব্যবস্থা নিয়েছিল রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাঙ্কগুলি। জেলা সদর সিউড়ি, দুবরাজপুর, বেশ কয়েকটি রষ্ট্রায়াত্ত ব্যাঙ্ক ঘুরে এমনই ছবি মিলল। কোথাও আলাদা লাইন কোথাও আলাদা লাইনের সঙ্গে ভিন্ন কাউন্টার রাখা হয়েছিল। এমনকী খয়রাশোল, রাজনগর, সিউড়ি— দুই ব্লকের রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাঙ্কের শাখাগুলিতেও একই ব্যবস্থা।
সিউড়ি দুই ব্লকের একটি রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাঙ্কের শাখা প্রবন্ধক বলছেন, ‘‘এই সময়ে যাতে চাকুরিজীবী বা পেনশনভোগীদের অসুবিধা না হয় তার জন্য আগাম প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।’’ কেউ কেউ বলছেন, খুব ভিড় হবে আজ সেই কারণে ব্যাঙ্ক মুখো হননি অনেকে। টাকার জোগান নিয়ে তাই খুব একটা সমস্যা হয়নি। স্কুল সেরে বেতনের টাকা তোলার জন্য দুবরাজপুরের একটি রাষ্টায়াত্ত ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে এক শিক্ষক বললেন, ‘‘আজ মনে হয় ভিড় অন্য দিনের তুলনায় কম। শুনলাম টাকা পেতেও সমস্যা নেই।’’
জেলার কোনও শাখা থেকে টাকা না পেয়ে ঘুরে গিয়েছেন এমন একটিও খবর তাঁর কানে পৌঁছয়নি বলে দাবি করেছেন জেলার লিড ব্যাঙ্ক ম্যানেজার দীপ্তেন্দ্র নারায়ণ ঠাকুর।
তবে প্রয়োজনের তুলনায় টাকার জোগান যে এখনও কম তা স্বীকার করে নিয়ে ওই আধিকারিক বলেন, ‘‘সংবাদমাধ্যমে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে বেতনের জন্য অতিরিক্ত টাকা ঢুকেছে সেটা এই জেলার ক্ষেত্রে এখনও ঘটেনি। ব্যাঙ্কগুলি নিজেদের ক্ষমতানুযায়ী সামাল দিয়েছে। শীঘ্রই টাকা ঢুকবে বলে জেনেছি। সামনের সপ্তাহ থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে আশা করি।’’
শিশির কুমার বর্ধন। রামপুরহাট পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সে রামপুরহাট গাঁধী স্টেডিয়াম সংলগ্ন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে মাস পয়লা পেনশনের টাকা তুলতে আসেন। নোট বদলের সিদ্ধান্তের পরেও নিজে একা হেঁটে হেঁটে ব্যাঙ্কে এসেছেন। খোঁজ নিয়েছেন পরিস্থিতির। মাস পয়লাতেও একা এসেছেন। দুপুর সাড়ে তিনটের সময় পেনশনের সম্পূর্ণ ১৮ হাজার টাকা বাড়ির পথে হাঁটতে শিশিরবাবুর সঙ্গে দেখা। জানালেন, ‘‘সিনিয়র সিটিজেনদের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আধ ঘণ্টাও অপেক্ষা করতে হয়নি।’’
ঘটনা হল, শিশিরবাবু পেনশনের সমস্ত টাকা ২০০০ টাকা নোটে পেয়েছেন। ব্যাঙ্ক কর্মীদের বলা সত্ত্বেও তাদের কাছে ছোট নোট না থাকার জন্য ২০০০ টাকার নোট নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হলেও খুচরো নিয়ে সমস্যাই থেকেই গেল জানালেন শিশিরবাবু। এত গেল মাস পয়লাতে যারা পেনশন প্রাপকদের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। অন্যদিকে মাস পয়লাতে রামপুরহাট শহরের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের শাখা থেকে পেনশন হোল্ডাররা তাদের প্রাপ্য পেনশন তুলতে পারলেও গ্রামাঞ্চলে চিত্রটা কিন্তু উলটো। সেখানে টাকা নাই বলে ঘুরে আসতে হয়েছে অনেককে। কোথাও পেনশন প্রাপকরা লম্বা লাইন দেখে ঘুরে এসেছেন।
রাজগ্রাম এলাকার বাসিন্দা অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক রসিক মুর্মু, মিসের সেখ, হরপ্রসাদ ঘোষরা তাঁদের বয়সের ভারে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি। কবে কীভাবে তাঁরা পেনশনের প্রাপ্য টাকা পাবেন সেই চিন্তায় তাঁদের ঘুম ছুটেছে। রাজগ্রাম এলাকায় একটি রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাঙ্কে টাকার জোগানই ছিল না। এলাকার গ্রামীণ ব্যাঙ্ক থেকে ১০০০ টাকা করে গ্রাহকরা পেয়েছেন। আবার লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে গ্রাহকরা ১০ হাজার টাকা করে পেয়েছেন। রাজগ্রাম ডাকঘর থেকে সাত দিন ধরে কোনও টাকা দেওয়া হচ্ছে না।
বিশ্বভারতীর বিভিন্ন স্তরের কর্মী অধ্যাপক, আধিকারিক থেকে শুরু করে পেনশনাররা এ দিনই টাকা তুলতে গিয়েছিলেন স্টেট ব্যাঙ্কের শান্তিনিকেতন শাখায়। বিশ্বভারতীর ক্যাজুয়েল কর্মী গোরাচাঁদ অধিকারী ও লক্ষ্মীনারায়ণ ঠাকুর বিকেল চারটের কিছু আগে দাঁড়িয়েছিলেন লাইনে। তাঁরা জানান, মিনিট দশেক লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। হাজার দশেক টাকা চেক দিয়ে তুলেছি। টাকা তোলা নিয়ে সেই অর্থে কোনও সমস্যা পোহাতে হয়নি। তবে গোরাচাঁদ বাবু ৫০০ টাকার নোট পেলেও, দু’ হাজার আর একশো টাকার নোট পেয়েছেন লক্ষ্মীনারায়ণবাবু।
বোলপুর, শান্তিনিকেতন এলাকার একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা এবং বেসরকারি ব্যাঙ্কেও লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা তুলেছেন গ্রাহকেরা। শান্তিনিকেতন ব্যাঙ্কের কাউন্টারে সেই অর্থে ভিড় না হলেও, এ দিন দুপুর তিনটে নাগাদ এটিএম এবং ই কর্নারে জনা পনেরো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। দিনের বাকি সময় এবং সন্ধ্যার পর অনায়াসে লোকজন গিয়ে টাকা তুলেছেন। টাকা পেয়েছেন সাঁইথিয়ার ব্যাঙ্কে পেনশন হোল্ডাররাও।
তবে মহম্মদবাজারের সেচ দফতরের এসডিও মহম্মদ এলাহি বক্স বলেন, ‘‘টাকা বাতিলের কারণে এ দিন অবসর প্রাপ্ত মানুষজনের পেনশন হয়নি। তাঁদের দেখে খুব অসহায় লাগছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। কালো বাজারি রুখতে আমিও নোট বাতিলকে সমর্থন করি। কিন্তু এর জন্য আগে সঠিক পদক্ষেপ করা উচিত ছিল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy