Advertisement
E-Paper

ঘরে বিমার কার্ড, তবু খসছে টাকা

কয়েক মাস আগে সিউড়ি জেলা হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয়েছিল সিউড়ি ২ ব্লকের হারাইপুর গ্রামের শেখ সফিকের। অস্ত্রোপচারের খরচ, ওষুধপথ্য বাবদ প্রায় ১২ হাজার টাকা জোগার করতে কালঘাম ছুটেছিল পেশায় রিকশা চালক ওই যুবকের। অথচ বাড়িতে ছিল রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমার কার্ড। যা দিয়ে সম্পূর্ণ বিনা খরচে ওই অস্ত্রোপচার হতে পারত। অথচ তিনি জানতেনই না! হুঁশ ফিরল যত দিনে তত দিনে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৬ ০২:০১

কয়েক মাস আগে সিউড়ি জেলা হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয়েছিল সিউড়ি ২ ব্লকের হারাইপুর গ্রামের শেখ সফিকের। অস্ত্রোপচারের খরচ, ওষুধপথ্য বাবদ প্রায় ১২ হাজার টাকা জোগার করতে কালঘাম ছুটেছিল পেশায় রিকশা চালক ওই যুবকের। অথচ বাড়িতে ছিল রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমার কার্ড। যা দিয়ে সম্পূর্ণ বিনা খরচে ওই অস্ত্রোপচার হতে পারত। অথচ তিনি জানতেনই না! হুঁশ ফিরল যত দিনে তত দিনে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।

শুধু কি ওই যুবক? বিমার কার্ড থাকলে ঠিক কী কী পরিষেবা একটি পরিবার পেতে পারে, ওই কার্ডের উপযোগিতাই বা কী— স্বাস্থ্যবিমার কার্ড থাকা বহু পরিবারের সদস্যরাই তা জানেন না। নানা রকমের অজ্ঞতা, ভ্রান্ত ধারণা সর্বোপরি ঠিক মতো প্রচারের অভাবে স্বাস্থ্যবিমা কার্ড থাকা সত্বেও পরিষেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বহু রোগী। অভিজ্ঞতা থেকেও তেমনটা দেখছেন সিউড়ি জেলা হাসপাতালে রোগী সহায়তা কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা কর্মী এবং চিকিৎসকেরা।

আরএসবিওয়াই বা রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা সেল সূত্রে জানা গিয়েছে, ‘আনঅর্গানাইজড ওয়ার্কার্স সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০০৮’- এ অসংগঠিত শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার ভাবনাই স্বাস্থ্য বিমা যোজনার উদ্দেশ্য। পরে সেটা আরও বড় আকারে দেশের সকল বিপিএল পরিবারকে স্বাস্থ্য বিমা যোজনার আওতায় আনার পরিকল্পনা করে কেন্দ্র। সেটা ২০১০ সাল।

এক জন কার্ড প্রাপক স্বামী-স্ত্রী এবং তিন জন নির্ভরশীল (পোষ্য)-সহ মোট পাঁচ সদস্যের জন্য বছরে ৩০ টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা খরচ বাবদ বছরে ৩০ হাজার টাকা পেতে পারেন। বিপিএল তালিকাভুক্ত পরিবার ছাড়াও ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে একটি অর্থবর্ষে ন্যূনতম ১৫ দিন কাজ করলে তিনিও স্বাস্থ্যবিমা কার্ড পাওয়ার অধিকারী। ২০১০ সালে কার্ড হওয়ার পরে পরপর তিন বছর ওই কার্ড নবীকরণ করা হয়েছে। ২০১৪ সালে কার্ড রিনিউ হয়নি। তবে নতুন কার্ড দেওয়া হয় ওই বছরই। সেই কার্ডের মেয়াদ ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত।

বীরভূমে মোট ৪ লক্ষ ২৯ হাজার কার্ড রয়েছে। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা এবং অস্ত্রোপচার-সহ মোট ১৪৪১টি প্যাকেজ রয়েছে। আগে আরএসবিওয়াই কর্তৃক চিহ্নিত বেসরকারি হাসপাতালগুলিতেই মূলত কার্ডধারীরা চিকিৎসা পেতেন। পরিকাঠামোয় কিছু উন্নতির পরে বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলিতেও এই সুবিধা মিলছে। সিউড়ি জেলা হাসপাতালের সুপার শোভন দে জানাচ্ছেন, ২০১৩ সালের শেষ দিকে সিউড়ি জেলা হাসপাতালকে স্বাস্থ্যবিমা কার্ড প্রাপকদের সুবিধা পাওয়ার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। রোগী এবং চিকিৎসকদের মধ্যে সমন্বয়
সাধনের জন্য তৈরি হয়েছে রোগী সহায়তা কেন্দ্র।

বীরভূমের সিউড়ি হাসপাতালের রোগী সহায়তা কেন্দ্রের কর্মী সন্তোষ দাস, সোমা মিত্ররা বলছেন, ‘‘স্বাস্থ্যবিমার কার্ড রয়েছে এমন অনেকে আছেন যাঁরা জানেনই না যে কার্ডটা হাসপাতালে নিয়ে এলে কী কাজে লাগবে। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে কার্ড আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে তবে জানতে পারি অনেকেই কার্ড থাকা সত্বেও সেটি বাড়িতে রেখে এসেছেন।’’ অস্ত্রোপচার হওয়ার পরে অনেকে জানতে পারেন কার্ড থাকলে একটি পয়সাও খরচ হত না। এমন অনেকে আছেন যিনি মনে করেন কার্ডের টাকা খরচ না করলে ভবিষ্যতে সেটা জমা থাকবে।

সহায়তা কেন্দ্রের কর্মীদের আক্ষেপ, ওষুধ থেকে যাতায়াত, অস্ত্রোপচার থেকে হাসপাতালের বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা (সিটি স্ক্যান, ডিজিটাল এক্স রে, ডায়ালিসিস ইত্যাদি) সব কিছুই ওই কার্ডের মাধ্যমে মেলে।

তা হলে কেন ওই কার্ডের ব্যবহার এত কম?

এর প্রধান কারণ কার্ডের উপযোগিতা জানাতে যে প্রচার প্রয়োজন ঠিক ভাবে সেটাই হয়নি। এমনটা মানছেন হাসপাতালের সুপার শোভনবাবুও। তিনি বলছেন, ‘‘রাজ্যের মধ্যে সিউড়ি হাসপাতাল কার্ড ব্যবহারের টার্ন-ওভারের নিরিখে চতুর্থ স্থানে। অঙ্কটা আরও অনেক বেশি হতে পারে বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে কার্ডের উপযোগিতা প্রচার করলেই।’’

প্রচার যে ঠিক ভাবে হয়নি তার প্রমাণ প্রদীপ ধীবর। সিউড়ির খটাঙ্গায় তাঁর বাড়ি। এই মুহূর্তে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। খাদ্যনালীতে জটিল অস্ত্রপাচার হয়েছে। এখনও পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২৫ হাজার। স্বাস্থ্যবিমার কার্ড রয়েছে প্রদীপের। কিন্তু সেটার ব্যবহার করেননি। কেন কার্ড ব্যবহার করলেন না? প্রদীপের জবাব, ‘‘শুনেছি কার্ডে দেখালে ওষুধ ভাল হয় না! তাই ব্যবহার করিনি।’’

উল্টো ছবিও আছে। জটিল অস্ত্রোপচারের পরে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন আলিয়া বিবি। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের ওই বধূর খরচের টাকা জোটানো সহজ ছিল না। যদি না স্বাস্থ্যবিমার কার্ড ব্যবহার করতেন তাঁর পরিবার।

সিউড়িতে না হয় রোগী সহায়তা কেন্দ্র রয়েছে। তাঁরা প্রচার করবেন। অন্য জায়গায় রোগীদের কার্ডের কথা কে বলবেন? রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা সেলের আধিকারিক তথা জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক হিমাদ্রী আড়ি জানাচ্ছেন, রোগী সহায়তা কেন্দ্র প্রতিটি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে তৈরি হচ্ছে। সিউড়ি মহকুমার ৭টি ব্লক হাসপাতালে সেই কাজ চলছে। ইতিমধ্যেই শুরু করছে জেলার সাইথিয়া ও ইলামবাজারে। প্রতিটি জায়গায় স্বাস্থ্যবিমা কার্ড সংক্রান্ত ফেস্টুন ব্যানার পৌঁছেছে। চিকিৎসক ও নার্সদের রোগীদের এ কথা জানাতেও বলা হয়েছে। হিমাদ্রিবাবু বলছেন, ‘‘তবে এটা ঠিক আরও বেশি মানুষকে সচেতন করতে প্রচার প্রয়োজন। আমরা বিষয়টি দেখেছি।’’ প্রচারে জোর দেওয়া হবে বলে আশ্বস্থ করেছেন অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) উমাশঙ্কর এস। যিনি আবার পদাধিকার বলে আরএসবিওয়াইএর জেলা নাডাল অফিসার।

তবে ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার উদাহরণও রয়েছে। সিউড়ি ২ ব্লকের হারাইপুরের শেখ সফিক কার্ড থাকা সত্বেও ধারদেনা করে টাকা জোগার করেছিলেন। একই অস্ত্রোপচারের জন্য গত মার্চে যখন তাঁর স্ত্রী সিউড়ি হাসপাতালে ভর্তি হন তখন তিনি স্বাস্থ্যবিমার কার্ড ব্যবহার করতে ভোলেননি। সে কথা তুলতেই সফিক জিভ কেটে বলছেন— ‘‘ওই ভুল আর করি!’’

যত কম রোগীকে ঠেকে শিখতে হয় ততই মঙ্গল, বলছেন অনেকেই।

ATM Insurance card
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy