তারাপীঠে পেট্রল পাম্প চত্বরেই তীর্থযাত্রীরা কেউ রান্না করছেন, কেউ ঘুমিয়ে রয়েছেন।
কীসের টানে তারাপীঠে
রাত ৯টা।
রামপুরহাট-সাঁইথিয়া সড়কের উপর তারাপীঠ ঢোকার মুখে কবিচন্দ্রপুর মৌজা সংলগ্ন পেট্রল পাম্প চত্ত্বরে শুয়ে বসে শ’দুয়েক দর্শনার্থী। তাঁদের মধ্যে জনা পঞ্চাশেক মহিলা আছেন। রাস্তার উপরে চায়ের দোকানে আরও জনা কুড়ি জন দর্শনার্থী। পঞ্চাশ থেকে ষাট বছর বয়সী প্রত্যেকেরই পরনে গেরুয়া রঙের বসন। জিজ্ঞাসা করতেই জানা গেল দুটি বাস ও দুটি ছোট গাড়ি করে তাঁরা এসেছেন। একদল এসেছেন বিহারের মতিহারি জেলা থেকে। আর এক দল এসেছেন উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলা থেকে। সকালে স্নান সেরে তারাপীঠে মা তারা দর্শন করবেন তাঁরা। রাত কাটাচ্ছেন পাম্প চত্ত্বরে। কেউ গ্যাসের উনুনে রুটি সব্জি তৈরিতে ব্যস্ত। কেউ ঘুমিয়ে কাদা। লজ-হোটেলের বাইরেও বহু মানুষ এভাবেই তারাপীঠে এসে রাত কাটান। কেন এই কষ্টের রাত্রিযাপন? ভিড়ের উত্তর, ‘‘তারামাকে দেখতে এসেছি। কোথায় থাকলাম, কেমন করে থাকলাম— ওসব ভাবিনি!’’
ভক্তি-বিশ্বাস সঙ্গে বেনিয়ম
তখন রাত ১০টা। তারাপীঠ দ্বারকা সেতু সংলগ্ন এলাকা। অটো চালক হাঁকছেন রামপুরহাট, রামপুরহাট রেলস্টেশন।
‘‘কেমন ভাড়া?’’
জানা গেল, ‘‘যাত্রী পিছু ২০ টাকা, তাড়া থাকলে রিজার্ভে ১০০ টাকা।’’
রাত দশটাতেও চার জন্য প্যাসেঞ্জার নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন অটোচালক। রাতের গৌর এক্সপ্রেস, জামালপুর এক্সপ্রেস, বনাঞ্চল এক্সপ্রেস, উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস এই সমস্ত ট্রেনের প্যাসেঞ্জার রামপুরহাট স্টেশন থেকে আনতে হয়। কেউ কেউ ওই সব ট্রেন ধরেই ফিরে যান। সেক্ষেত্রে, রিজার্ভ প্যাসেঞ্জার ধরাটাই অটোর দস্তুর। রাতের দিকে চলে টোটোও। ছ’ জন প্যাসেঞ্জার রামপুরহাট যাওয়ার জন্য দ্বারকা সেতুর উপর গাড়িতে চাপতেই রে রে করে মুন্ডমালিনীর দিকে দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যান চালকরা তেড়ে এলেন। প্রত্যেকের পা টলমল, মুখে অশ্রাব্য ভাষায় গালি গালাজ, টোটো চালকের সঙ্গে বচসাতে টোটোর চাবি কেড়ে নিতে চাইছে ভ্যান চালকরা। মিনিট খানেক ধরে টানা হেঁচড়াতে যাত্রী ভর্তি টোটো উলটে যাওয়ার উপক্রম। টোটোতে থাকা শিশু সহ মহিলা যাত্রীদের ভয়ার্ত চীৎকার। নেমে পড়লেন তাঁরা। গোলমালের খবর পেতেই এলাকায় পৌঁছল পুলিশ।
ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ১০টা ছুঁয়েছে।
সেতু থেকে নেমে অটো ও ট্রেকার স্ট্যন্ডে ঘোরাঘুরি করতেই পিছন থেকে ডাক শোনা গেল।
‘‘ও দাদা রুম লাগবে নাকি?’’
‘‘কিন্তু আমাদের কাছে কোনও প্রমাণপত্র নেই।’’
জানা গেল, ‘‘সব মিলে যাবে। কোনও পরিচয় পত্র লাগবে না।’’ ঘটনা হল, উপযুক্ত প্রমাণপত্র ছাড়া লজের ঘর ভাড়া দেওয়া নিয়ে তারাপীঠ লজ মালিকরা এখনও যে উদাসীন তার আরও বড় প্রমাণ মিলল ওই যুবকের কথায়! তাঁর কথায়, রাত বাড়লে অত নিয়ম-বিধি মেনে কাজ হয় না। তখন নগদ কথা বলে।
দ্বারকা নদীর বামা খ্যাপার ঘাটে চলছে গাঁজার আসর।
শশ্মানে চুল্লি জ্বলছে
রাত দশটা পঁয়তাল্লিশ। রাত বাড়ছে। চটুল গান ভেসে আসছে।
তারাপীঠ শ্মশানের পঞ্চমুন্ডির আশ্রম তলা যাওয়ার পথে ঝুপসি আলো-অন্ধকার। সাধারণত দিনের বেলায় এই সমস্ত দোকানগুলিতে তারা মায়ের মাহাত্ম্য নিয়ে কীর্তন, শ্যামা সঙ্গীত শুনতে পাওয়া যায়। সম্প্রতি পঞ্চ মুন্ডির আশ্রম সংস্কার করেছে তারাপীঠ রামপুরহাট উন্নয়ন পর্ষদ। আলো আঁধারি পরিবেশে আশ্রমের মন্দির গায়ে, বলিদানের জায়গায় মোমবাতি জ্বলছে। ধূপ কাঠি জ্বলছে। আশ্রম লাগোয়া চাতাল থেকে টলোমলো পায়ে চারজন যুবক মা তারার জয় দিতে দিতে মন্দির যাওয়ার পথ ধরে এগিয়ে গেল। কিন্তু একটু আগেই মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়েছে!
সামনে এগিয়ে সাধুদের পুর্নবাসন এলাকা। সেই ভান্ডারা প্রাঙ্গণে তখন শ’ খানেক লোক সেখানে রাত কাটানোর ব্যবস্থা করছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মশারি খাটাচ্ছেন। কেউ বা জয় তারা বলে শুয়ে পড়লেন। এ বার মহাশ্মশান।
অন্ধাকারে পথ ঠাওর করে এগোতে এগোতে দূর থেকে চিতার ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল। দাহ হয়েছে একটু আগে।
কয়েকজন বসেছিলেন।
হাতে হাতে ঘুরছে নেশার সামগ্রী। রাত পৌনে এগারটা। শ্মশান লাগোয়া দ্বারকা নদীর স্নান ঘাট। গাঁজা মদ খাওয়া নিষিদ্ধ এই এলাকায়। কিন্তু কে কার কথা শোনে। এলাকা ঢেকে যাচ্ছে ছিলিমের ধোঁয়ায়।
দোকান খোলে সন্ধ্যা রাতে
রাত এগারোটা।
তারাপীঠ থানা এলাকায় দেখা মিলল রামপুরহাট মহকুমা পুলিশ আধিকারিক কমল বৈরাগ্য, রামপুরহাট সিআই দেবদয়াল কুন্ডর সঙ্গে। কৌশিকী অমাবস্যার জন্য সিসিটিভি লাগানো-সহ অন্য প্রস্তুতির তদারকি করছেন তাঁরা। রাত বাড়তেই দ্বারকা সেতুর দিকে এগোন গেল। আবছা অন্ধকারের মধ্যেই পর পর কয়েকটা দোকান। সন্ধে থেকে রাত দুটো পর্যন্ত খোলা থাকে এই সব দোকান। রুটি সব্জি, মাংস — একটু বেশি টাকা দিলে আরও কিছু! কয়েকজন দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে গরম গরম রুটি-তরকা খাচ্ছেন।
মধ্যরাত।
দ্বারকা সেতু থেকে মন্দির যাওয়ার রাস্তা দোকান বন্ধ হতেই প্রগাঢ় অন্ধকার নামল এলাকায়।
শ্মশান এলাকা থেকে শোনা গেল সিভিক ভলান্টিয়ারের গলা। চিতার উপর মদ খেয়ে যজ্ঞ করার জন্য শেওড়াফুলি থেকে আসা এক তান্ত্রিককে মদ্যপ অবস্থায় ঝামেলা বাধানোয় তাঁরা লাঠি পেটা করে সরিয়ে দিলেন তাঁকে। ও দিকে বন্ধ মন্দির চত্ত্বরের সিঁড়ির নীচে চলছে ভক্তের আকুতি, ‘‘মা আমায় ক্ষমা করে দে মা!’’
কৌশিকী অমাবস্যার আগের রবিবারে তারাপীঠের মন্দিরে পুজো দেওয়ার ভিড়। —নিজস্ব চিত্র
— ছবি তুলেছেন সব্যসাচী ইসলাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy