Advertisement
০২ মে ২০২৪

হোমের মেয়ের দেহ পড়ে মর্গে

বাবা-মা তার অনেককাল আগেই মারা গিয়েছেন। এখন সেই কিশোরীর দেহ পনেরো দিন ধরে পড়ে বাঁকুড়া মেডিক্যালের লাশকাটা ঘরে। আত্মীয়েরা নিতে আসেননি। ওই কিশোরী এতদিন যেখানে ছিল, পুরুলিয়ার সেই সরকারি হোম আনন্দমঠ কর্তৃপক্ষও কেন দেহ নিতে আসেনি, তা নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন।

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:৫৭
Share: Save:

বাবা-মা তার অনেককাল আগেই মারা গিয়েছেন। এখন সেই কিশোরীর দেহ পনেরো দিন ধরে পড়ে বাঁকুড়া মেডিক্যালের লাশকাটা ঘরে। আত্মীয়েরা নিতে আসেননি। ওই কিশোরী এতদিন যেখানে ছিল, পুরুলিয়ার সেই সরকারি হোম আনন্দমঠ কর্তৃপক্ষও কেন দেহ নিতে আসেনি, তা নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন।

পুরুলিয়া শহর লাগোয়া ওই হোম সূত্রের খবর, বছর সতেরোর কিশোরী পায়েল শূর শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছিল। অগস্টের প্রথম সপ্তাহে তাকে প্রথমে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে টানা এক সপ্তাহ থাকার পরেও উন্নতি না হওয়ায় তাকে বাঁকুড়া মেডিক্যালে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৭ অগস্ট সেখানেই পায়েলের মৃত্যু হয়। কিন্তু এরপর থেকে তার দেহ পড়ে রয়েছে মর্গে। হাসপাতাল সূত্রে খবর, কিশোরীর মৃত্যুর পরে হোমের প্রতিনিধিদের দেহটি নিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা রাজি হননি। সেই থেকে মর্গে জমে থাকা অন্য বেওয়ারিশ দেহের পাশে পড়ে রয়েছে পায়েলের দেহও।

ওই আবাসিকের মৃত্যুর কারণ নিয়ে ইতিমধ্যেই তদন্তের দাবি জানিয়ে পুরুলিয়ার জেলাশাসকের দ্বারস্থ হয়েছে হিউম্যান রাইটস ফোরাম। ওই সংগঠনের পুরুলিয়া জেলা সভাপতি আবু সুফিয়ানের মন্তব্য, ‘‘হোমের এক আবাসিক রোগেভুগে মারা যাওয়ার পরেও মর্গে দিনের পর দিন পরে থাকাটা খুবই অমানবিক। হোম বা প্রশাসনের অবিলম্বে তার দেহ সৎকার করা উচিত।’’

যদিও আনন্দমঠ হোমের সুপার হৈমন্তী হেমব্রমের প্রশ্ন, ‘‘পায়েলের দেহ কাকে দেব? ওর এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তাঁরা লিখে দিয়েছেন, দেহ নেবেন না।’’ তাহলে কী হবে? তিনি বলেন, ‘‘এখন আইন অনুযায়ী যা হওয়ার তাই হবে।’‌’ পুরুলিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) অরুণ প্রসাদ বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত ওই কিশোরীর দেহ অন্ত্যেষ্টির জন্য কেউ দাবি করেননি। এ বার বিধি মোতাবেক যা হওয়ার তাই হবে।’’ কিন্তু হোমের আবাসিক মারা গেলে, তার দেহ দাহ করতে হোম কেন দায়িত্ব নেবে না, সে প্রশ্নের সদুত্তর কারও কাছে মেলেনি। মর্গের দায়িত্ব থাকে পুলিশের উপর। বাঁকুড়া জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘কিছুদিন মর্গে দেহ রেখে সৎকার করে দেওয়া হয়। হোম না নিয়ে গেলে এ ক্ষেত্রে তাই করা হবে।’’

পায়েলকে এই হোমে পাঠানোর ব্যাপারে প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন আবু সুফিয়ান। তিনি জানান, পায়েলের বাবা পুলিশের চাকরি করতেন। ২০০২ সালে পথ দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। ২০০৪ সালে পায়েলের মা মারা যান। এরপর পুরুলিয়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে তার ঠাঁই হয়। কিন্তু ২০০৭ সালে রেললাইনের পাশ থেকে পায়েলকে পাওয়া যায়। সে জানিয়েছিল, আত্মীয়ের বাড়িতে অত্যাচারে সে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। সেই থেকে সে হোমে ছিল। কিন্তু মৃত্যুর পরেও তাঁর দেহ নিয়ে যা হচ্ছে তা অমানবিক বলে মনে করেন আবু সুফিয়ান।

তিনি ইতিমধ্যেই ওই হোমের খাবারদাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে জেলাশাসককে চিঠি দিয়েছেন। তাঁর দাবি, গত কয়েক বছরে আরও চার আবাসিকের মৃত্যু হয়েছে। এই মেয়েগুলির মৃত্যুর প্রকৃত কারণ কী ছিল তাও খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘হোম কর্তৃপক্ষ পায়েলের মৃত্যু শ্বাসকষ্ট জনিত কারণে হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে দাবি করলেও যক্ষার কারণেও হতে পারে। পুষ্টির অভাবেই এই মেয়েটি যক্ষার শিকার হয়েছিল কি না তারও তদন্ত দাবি করেছি।’’ একই দাবি তিনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে ও রাজ্য সরকারের সমাজ কল্যাণ দফতরের কাছেও পাঠিয়েছেন। যদিও হোমের সুপারের দাবি, ‘‘খাবারের মান নিয়ে তোলা অভিযোগ ঠিক নয়।’’ কিন্তু পায়েলের দেহ কি তবে মর্গেই পড়ে থাকবে? তখন সুপারের জবাব আর মেলেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

girl’s dead body Morgue
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE