Advertisement
০২ মে ২০২৪
বধূর নৃশংস খুনে শোরগোল সাঁইথিয়ায়

মেঝেয় পড়ে মা, দেখল উৎস

ঘুম থেকে উঠে ঘরে বাবা-মা কাউকে দেখতে পায়নি সে। সেখান থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে চোখ যেতেই ভয়ানক দৃশ্যটা বছর এগারোর ছেলেটির চোখে গেঁথে যায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। আর সেখানেই বিবস্ত্র অবস্থায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে রয়েছে তার মায়ের দেহ।

এ ভাবেই পড়েছিল নিহত বধূর দেহ। ইনসেটে নিহত মণি বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার সকালে সাঁইথিয়ার রথতলা এলাকায় ছবিটি তুলেছেন অনির্বাণ সেন।

এ ভাবেই পড়েছিল নিহত বধূর দেহ। ইনসেটে নিহত মণি বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার সকালে সাঁইথিয়ার রথতলা এলাকায় ছবিটি তুলেছেন অনির্বাণ সেন।

ভাস্করজ্যোতি মজুমদার
সাঁইথিয়া শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৫ ০১:৩৬
Share: Save:

ঘুম থেকে উঠে ঘরে বাবা-মা কাউকে দেখতে পায়নি সে। সেখান থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে চোখ যেতেই ভয়ানক দৃশ্যটা বছর এগারোর ছেলেটির চোখে গেঁথে যায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। আর সেখানেই বিবস্ত্র অবস্থায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে রয়েছে তার মায়ের দেহ।

শুক্রবার সকালে সাঁইথিয়া শহরের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের রথতলা পাড়ার ঘটনা। পুলিশ জানায়, নিহত বধূর নাম মণি বন্দ্যোপাধ্যায় (৩০)। এলাকার অভিযাত পরিবারের ওই মহিলার এমন নৃশংস খুনের কথা চাউর হতেই চাঞ্চল্য ছড়ায় সাঁইথিয়ায়। যদিও ঘটনার পর থেকেই বেপাত্তা মণিদেবীর স্বামী বলাই চট্টোপাধ্যায়। এ দিনই তাঁর বিরুদ্ধে খুনের লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন নিহত বধূর বাবা। অভিযুক্তের খোঁজ শুরু করেছে পুলিশ। বহু চেষ্টা করেও জেলার পুলিশ সুপার মুকেশ কুমারের সঙ্গে এ দিন যোগাযোগ করা যায়নি। এ দিনই সিউড়ি হাসপাতালে মণিদেবীর ময়না-তদন্ত হয়েছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, ২০০১ সালে মহম্মদবাজারের গণপুরের বাসিন্দা বিবেকানন্দ সরকারের মেয়ে মণির সঙ্গে সাঁইথিয়ার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিয়ে হয়েছিল। উজ্জ্বলবাবু পরে স্ত্রীকে নিয়ে রথতলা পাড়ায় বাড়ি করে থাকতে শুরু করেন। দম্পতির একটি ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে উজ্জ্বলবাবুর মৃত্যু হয়। বছর দু’য়েক বাদে উজ্জ্বলবাবুরই নিকট বন্ধু বলাই ওরফে ভানুকে বিয়ে করেন মণিদেবী। বলাইবাবুর বাড়ি বর্ধমান জেলার পাণ্ডবেশ্বরের গৌড়বাজারে হলেও বিয়ের পরে তিনি মণিদেবীর সঙ্গে রথতলার ওই বাড়িতেই থাকতে শুরু করেছিলেন। মণিদেবীর মা তৃপ্তিদেবী এবং বাবা বিবেকানন্দবাবুর দাবি, ‘‘এখনকার সমস্ত কিছুই উজ্জ্বলের করা। সংসারের জন্য বলাই কার্যত কিছুই করত না। বলাই প্রায়ই পাণ্ডবেশ্বর চলে যেত। তাই গত মাসে এই বাড়ির একতলায় ওকে একটি মুদিখানার দোকান করে দেওয়া হয়েছিল। তার পরেও মেয়ের সঙ্গে বলাই প্রায় দিনই অশান্তি করত।’’ ওই অশান্তিই কি এই ঘটনার নেপথ্যে কিনা, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

এ দিন সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ এলাকায় গিয়ে দেখা যায় মণিদেবীর বাড়ির সামনে কৌতুহলী জমতার ভিড়। সাজানো গোছানো মার্বেল পাথর বসানো বাড়ি। বাড়ির প্রবেশ পথের ডান দিকে রাখা একটি চার চাকা গাড়ি। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠেই ডাইনিং। ডাইনিংয়ের পূর্বে পাশাপাশি দু’টি বেডরুম। একটি বড়, একটু তুলনায় ছোট। ছোট ঘরের পাশেই রান্নাঘর। তিন তলার সিঁড়িতে টবে পাতাবাহারের গাছ। সব কিছুই পরিপাটি করে সাজানো। বড়ঘর ও রান্নাঘরের মাঝে থাকা ছোট বেডরুমটির মেঝেতেই পড়ে রয়েছে মণিদেবীর রক্তাক্ত দেহ। তত ক্ষণে অবশ্য তাঁর শরীর ঢেকে দেওয়া হয়েছে চাদরে। তবে, খাটের বিছানা ও মেঝের বিভিন্ন জায়গায় তখনও রয়েছে চাপচাপ রক্তের দাগ। খাটের উপরে রক্তাক্ত ছোট কাটারি ও বালিশ, মৃতদেহের পাশে রক্তাক্ত ছুরি— সবই পড়ে রয়েছে।

নিহত বধূর প্রথম পক্ষের ছেলে উৎস ষষ্ঠ এবং মেয়ে রূপসা প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। উৎস এ দিন বলে, ‘‘রোজকার মতো বৃহস্পতিবার রাতেও আমরা সবাই একসঙ্গে রাতের খাবার খেয়েছি। খাওয়ার পরে আমি আর বোন মায়ের সঙ্গে টিভি দেখতে বসেছিলাম। কিন্তু, বাবা আমাদের সঙ্গে টিভি দেখেনি। ডাইনিংয়ে পায়চারি করছিল।’’ রাত ১১টা নাগাদ টিভি বন্ধ বড় ঘরের খাটে মায়ের সঙ্গে দাদা-বোনে শুয়ে পড়ে। এমনিতে চার জন এক খাটে অসুবিধা হতো বলে বলাইবাবু মেঝেতে ঘুমোতেন। বৃহস্পতিবার রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় অবশ্য বলাইবাবুকে আসতে দেখেনি বলে উৎসর দাবি। তার কথায়, ‘‘শোওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই আমরা ঘুমিয়ে যাই। সকাল ৯টা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে ঘরে মা-বাবা কাউকেই দেখতে না পেয়ে ছোট ঘরের দরজা খুলে দেখি, ওই ভাবে পড়ে রয়েছে মা। অনেক ডাকি, কিন্তু মা কোনও সাড়া দেয়নি।’’

এর পরেই ছেলেটি নীচে নেমে দেখে কোলাপসিবল গেটে তালা দেওয়া। সামনেই পড়ে আছে তার চাবি। বাইরের দরজা হাট করে খোলা। মোটরবাইকটিও নেই। প্রথমটা ঘাবড়ে গেলেও মাথা ঠান্ডা রাখে উৎস। পাঁচ বছরের বোনকে কিছু না বুঝতে দিয়ে দাদু-দিদাকে মোবাইল থেকে ফোনে ঘটনার কথা জানায় ছোট্ট উৎস। বাবা কি মাকে মারধর করতেন? এ দিন নিহত মণিদেবীর ছেলের জবাব, ‘‘মাঝে মধ্যেই মা-বাবা ঝগড়া করত। এক-দু’বার চুলের মুঠি ধরে বাবা মাকে খুব মেরেওছে। মাকে মেরে ফেলার হুমকিও দিতে শুনেছি।’’

এ দিকে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের ধারণা, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে পরিকল্পিত ভাবে ওই খুন করা হয়েছে। তার প্রস্তুতি হিসাবে রান্নাঘর থেকে আগে থাকতেই কাটারি ও ছুরি এনে রাখা হয়েছিল। সম্ভবত সহবাসের জন্য মণিদেবীকে বড়ঘর থেকে ওই ছোট ঘরে ডেকেও আনা হয়েছিল। তার পরেই প্রথমে বালিশ দিয়ে তাঁর শ্বাসরোধ করা হয়। তার পরে কপালে কাটারি দিয়ে আঘাত করা হয়। ছুরি দিয়ে কাটা হয় গলার নলিও। প্রাথমিক তদন্তে, পুলিশের সন্দেহে নিশানায় নিহতের স্বামীই রয়েছেন। তবে, খুনের সঙ্গে আরও কেউ যুক্ত ছিলেন কিনা, সে সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

যদিও এখনও পর্যন্ত খুনের কারণ স্পষ্ট নয় পুলিশের কাছে। যদিও মণিদেবীর বাবার দাবি, প্রথম পক্ষের স্বামীর কাছ থেকে তাঁর মেয়ে বহু সোনাদানা, টাকাপয়সা ও সম্পত্তি পেয়েছিলেন। ঘটনার পর থেকে বাড়ির আলমারি ও ব্যাঙ্কের লকারের চাবিও পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর অভিযোগ, ‘‘সম্পত্তি হাতাতেই বলাই মেয়েকে খুন করেছে। এখন মনে হচ্ছে ওই সম্পত্তির লোভেই হয়তো সে মণিকে বিয়ে করেছিল।’’ মেয়ের খুনির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তিনি জানিয়েছেন। এ দিন বহু চেষ্টা করেও বলাইবাবুর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

দেহ উদ্ধার। এক বধূর অস্বাভাবিক মৃতদেহ উদ্ধার করল পুলিশ। শুক্রবার সকালে সাঁইথিয়া পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মনসাপল্লির ঘটনা। পুলিশ জানায়, ওই বধূর নাম মিতা ঘোষ (২৭)। স্বামীর নাম নাড়ু ঘোষ। আর পাঁচটা দিনের মতোই বৃহস্পতিবার রাতে খাওয়াদাওয়া করে স্বামী, সন্তানের সঙ্গে শুয়ে ছিলেন তিনি। সকালে গলায় শাড়ির ফাঁস লাগানো অবস্থায় তাঁর ঝুলন্ত দেহ মেলে। অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করে ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sainthia House wife mohammadbazar police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE