দীর্ঘ লাইন। ছিল পুলিশি নজরদারি। ব্যাঙ্ক, পোস্টঅফিস কর্মীদের তৎপরতা। এবং দু’ একটি ছোটখাটো বিশৃঙ্খলতাও।
বৃহস্পতিবার দিনভর যেমনটা ভাবা হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই কাটল জেলার নানা প্রান্ত। দুশ্চিন্তা ও লাইনে দাঁড়ানোর ক্লান্তি এড়িয়েই এ দিন টাকা জমা দেওয়া ও টাকা বদল করলেন বহু মানুষ। আক্ষেপ একটাই, যে নতুন পাঁচশো ও হাজারের নোট নিয়ে এত চর্চা সেই ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোটের দেখা পাওয়া গেল না। অন্তত বৃহস্পতিবার বেলা দুটো পর্যন্ত মিলল এমনই ছবি।
সিউড়ি জেলা সদর, দুবরাজপুর, খয়রাশোল, রাজনগরের কোনও ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিস থেকেই নতুন টাকা পাননি বলছেন গ্রাহকেরা। ব্যাঙ্ক ও পোস্ট অফিস সূত্রে জানা গিয়েছে, নতুন নোট না আসায় ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরের লেনদেন বা টাকা বদল সীমাবদ্ধ থেকেছে পুরানো ১০০, ৫০, ২০ ও ১০ টাকার নোটেই। গ্রাহকের আক্ষেপ, নতুন নোট হাতে পেলে ভাল লাগত। বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাঙ্ক ও ডাকঘর সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার না পেলেও শুক্রবার থেকে নতুন নোট ঠিকই হাতে পাবেন গ্রাহকেরা।
এ দিন মওকা বুঝে রীতিমতো টেবিল সাজিয়ে বুধবার থেকে সিউড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় জমিয়ে বেআইনি কারবার ফেঁদেছিল কয়েকজন। পাঁচশো টাকার নোটের বদলে চারশো, আর হাজারের নোটে মিলছিল আটশো! বিষয়টি পথচলতিদের নজরে পড়ায় কেউ কেউ মোবাইল বন্দি করেছিলেন সেই দৃশ্য। খবর পায় পুলিশও। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালে অভিযানে এসে পুলিশ দেখে টেবিল রয়েছে। হাতে লেখা টাকার কারবারের বিজ্ঞাপনও রয়েছে। কিন্তু টাকা নিয়ে কেটে পড়েছে কারবারিরা। অগত্যা ফাঁকা টেবিলই থানায় নিয়ে যায় সিউড়ি পুলিশ।
সাত সকালে জেলার প্রায় সব ব্যাঙ্কের বাইরেই দীর্ঘ লাইন পড়তে দেখা যায়।
সিউড়ি, বোলপুর ও রামপুরহাট তিন মহকুমাতেই একই ছবি। খয়রাশোল, হেতমপুর-সহ গ্রামঞ্চলে গ্রামীণ ব্যাঙ্কগুলিতেও কয়েক শো মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গিয়েছে। বিকাল পর্যন্তও বহু জায়গায় ছবিটা বদলায়নি। সকালে সিউড়িতে ব্যাঙ্কের লাইনে অপেক্ষায় ছিলেন সপ্তদীপ সরকার, সৌমেন ঘোষালদের মতো আরও অনেকেই। বেসরকারি সংস্থার কর্মী আদতে দুবরাজপুরের বাসিন্দা সপ্তদীপ বলছেন, ‘‘টাকা জমা দিতে এসেছি।’’ অন্যদিকে টাকা বদলানোর জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন সিউড়ির রবীন্দ্ররপল্লির সৌমেনবাবু। দুবরাজপুরে একটি রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যঙ্কের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন জোপলাই গ্রামের অমিতাভ ঘোষ। মঙ্গলবারই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলেছিলেন। কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্তে সেটা বাতিল হওয়ায় বদলাতে এসেছিলেন সেই টাকা।
লিঙ্ক না থাকায় সিউড়ির দুটি ব্যাঙ্কে ও রামপুরহাটে পোস্ট অফিসে বেশ কিছুক্ষণ থমকে ছিল কাজ। এমন ছোটখাটো বিশৃঙ্খলা ছাড়া এখনও পর্যন্ত কোনও অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি রামপুরহাটেও। মল্লারপুরের বাসিন্দা শৈবাল রায় জানান, ‘‘মল্লারপুর স্টেট ব্যাঙ্কে আড়াইঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে টাকা জমা দিয়েছি। কোনও অশান্তি বা বিশৃঙ্খলা হয়নি।’’ সকাল সাড়ে আটটা থেকেই স্টেটব্যাঙ্কের রামপুরহাট শাখার প্রধান কার্যালয়ের সামনে পঞ্চাশ জনের লাইন দেখতে পাওয়া যায়। ঘন্টা খানেকের মধ্যে সেই ভিড় চারগুন বেড়ে যায়। তবে নিশ্চিন্তপুর এলাকায় স্টেট ব্যাঙ্কের অন্য একটি শাখায় লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে হাতাহাতি বেধে যায়। পরে এলাকায় পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। নিশ্চিন্তপুর শাখাতেই গিয়ে দেখা গেল কেউ কেউ পেনশন বাবদ কিছু টাকা জমা দিচ্ছেন। জেঁদুর গ্রামের ৮০ বছরের এক বৃদ্ধা লাইনে দাঁড়িয়ে পেনশনের টাকা জমা দিতে এসেছিলেন। হিমাদপুরের চাষি হেমন্ত লেট লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বলেন, ‘‘ধান বিক্রি বাবদ ১২ হাজার টাকা ছিল। সবটাই ৫০০ টাকার নোট। ধান কাটার মরশুম চলছে। মজুরি দিতে হবে। তাই ব্যাঙ্কে এসে টাকা জমা দিয়ে ৪০০০ টাকা বদল করছি।’’
জেলার প্রতিটি ব্যাঙ্কের সামনে গ্রাহকদের লাইনে যাতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে তার জন্য উদ্যোগী হল প্রশাসনও।
সিউড়ি, রামপুরহাটের মতো বোলপুরেও এ দিন দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে শান্তিনিকেতনের একটি ব্যাঙ্কের সামনে থেকে ভিড় জমতে শুরু করে। লাইনটি বিশ্বভারতী প্রথম গেটের উল্টো দিকের রাস্তায় পৌষমেলার মাঠ পর্যন্ত। ওই লাইনের দাঁড়িয়ে গ্রাহক সোমনাথ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সকাল সাড়ে সাতটা থেকে দাঁড়িয়েছি ঠিকই। কিন্তু ব্যবস্থাপনা ভাল।’’ একই কথা বলছেন প্রদীপ কুমার কর, পারমিতা দাসরা।
একই ভাবে শান্তিনিকেতনের ডাকঘর থেকে শুরু করে বোলপুরের প্রতিটি ব্যাঙ্ক ও ডাকঘরের সমান ভিড় জমতে থাকে। লাইন ছিল ডাকঘরের শান্তিনিকেতন শাখায়। মাঝে লিঙ্ক বিপর্যস্তের কারণে লেনদেন কিছুটা সমস্যা হয়েছে দুপুরের দিকে। গ্রাহকদের লাইনের কারণে, এ দিন টিফিন পর্যন্ত বাতিল করেছেন ডাকঘরের কর্মীরা। এ দিন অচল টাকা বদলানো না গেলেও, নোট বদলানো গিয়েছে সব ব্যাঙ্কেই।
আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায় তার জন্য আগেই পরিকল্পনা নিয়েছিল পুলিশ। বুধবার রাতে বোলপুরের এসডিপিও অম্লান কুসুম ঘোষ, মহকুমার পুলিশ অফিসারদের নিয়ে বৈঠক করেন।