বাড়িতে তিনটে গরু রয়েছে। আরও কয়েকটি কিনে ‘ডেয়ারি ফার্ম’ তৈরি করে সংসারের হাল ধরতে চান তিনি। তার জন্য সংখ্যালঘু দফতর থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। ঋণ পাওয়ার প্রাথমিক শর্ত হিসেবে দরকার ছিল একটি ‘ট্রেড লাইসেন্স’। কিন্তু আবেদনকারীর অভিযোগ, রাজনৈতিক আক্রোশে গত দশ দিন ধরে ঘুরলেও পঞ্চায়েত সহযোগিতা করেনি। এমনকী, প্রধানকে খোদ বিডিও নির্দেশ দিলেও প্রয়োজনীয় ট্রেড লাইসেন্স পাননি দুবরাজপুরের লোবা পঞ্চায়েতের ফকিরবেড়া গ্রামের যুবক মহম্মদ আনাস।
যুবকের দাবি, এক সময় লোবার ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’র সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। তখন তৃণমূলের সঙ্গে কমিটির বিরোধের জেরেই বর্তমানে শাসকদলের দখলে থাকা পঞ্চায়েত তাঁর সঙ্গে এমন অসহযোগিতা করছে। তৃণমূলের নেতারা যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁদের পাল্টা দাবি, প্রয়োজনীয় নথি দেখাতে না পারায় ওই যুবককে লাইসেন্স দেওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে দুবরাজপুরের বিডিও বনমালি রায় অবশ্য বলেছেন, ‘‘পরিবারটি আমার কাছে এসেছিল। আমি প্রধানকে লাইসেন্স দিতে বলেছি। প্রধান নিজের মতো তদন্ত করে তা দেবেন। অনির্দিষ্ট কাল তো এ ভাবে চলতে পারে না। প্রধান যদি ওই যুবককে লাইসেন্স না দেওয়ার সঙ্গত কারণ দেখাতে না পারেন, তা হলে পদক্ষেপ করব।’’
ঠিক কী ঘটেছে?
আনাসের অভিযোগ, সংখ্যালঘু দফতরে ঋণের আবেদন করবেন বলে গত ৮ অগস্ট থেকে দিনের পর দিন তিনি পঞ্চায়েত অফিসে গিয়েছেন। প্রয়োজনীয় নথিপত্র, পড়শিদের নো-অবজেকশন এবং নির্ধারিত টাকা দিতে চাইলেও পঞ্চায়েত তাঁকে ট্রেড লাইসেন্স দিতে রাজি হয়নি। আনাসের দাবি, ‘‘যত বার গিয়েছি, প্রতিবারই পঞ্চায়েত নানা অজুহাত দেখিয়ে চলেছে। কখনও বলছে, এখন দিন কয়েক ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। কখনও বলছে, আমার নথিপত্র ঠিক নেই। দিনের পর দিন ঘুরেও লাইসেন্স না পেয়ে বিডিও-র দ্বারস্থ হই। তিনি প্রধানকে লিখে দিলেও সেই আবেদন গ্রাহ্য করেননি প্রধান।’’ তাঁর আক্ষেপ, তাঁদের পরিবারকে ‘তৃণমূল-বিরোধী’ তকমা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ তাঁরা এখন তৃণমূলই করেন।
ঘটনা হল, ২০১২ সালে লোবা-কাণ্ডের পরে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক ছিল আন্দোলনরত কৃষিজমি রক্ষা কমিটির। ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটে এলাকার দখল রাখতে কমিটি তৃণমূলের বিরুদ্ধে নির্দল প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিল। কমিটির হয়ে আনাসের স্ত্রী খালিদা পঞ্চায়েত সমিতির আসনটির জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। তখন কমিটির অভিযোগ করেছিল, শাসকদলের চাপে মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন খালিদা। কিন্তু তাঁর পরেও আনাসের পরিবারের প্রতি আক্রোশ যায়নি। কমিটির অন্য এক প্রার্থীর হয়ে চণ্ডীপুরে প্রচার চালাতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত হন আনাস। মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয় তাঁর। খালিদাই তখন স্বামীর উপর আক্রমণের জন্য এলাকার এক তৃণমূল নেতা-সহ ছ’জনের নামে অভিযোগ দায়ের করেন। তখন পাল্টা অভিযোগ দায়ের করেছিল তৃণমূলও। ভোটের ফলে পঞ্চায়েতে ক্ষমতায় আসে তৃণমূলই। কিন্তু মামলা ওঠেনি। তা এখনও বিচারাধীন। খালিদা দাবি করছেন, ‘‘পঞ্চায়েতের এই অসহযোগিতা সেই আক্রোশেরই জের। মামলা তুলতে সরাসরি চাপ না দিয়ে এ ভাবে শোধ নিচ্ছে।’’
যদিও অভিযোগ মানতে রাজি নয় তৃণমূল। লোবার তৃণমূল প্রধান মণি দাস বলছেন, ‘‘আমরা উন্নয়নের কাজে আপন-বিরোধী বলে কিছু দেখি না।’’ তা হলে আনাসকে এত ঘুরতে হচ্ছে কেন? প্রধানের দাবি, ‘‘এখনও কিছু নথি বাকি রয়েছে। উনি উপযুক্ত নথিপত্র নিয়ে এলেই লাইসেন্স পাবেন।’’ একই সুরে অভিযোগ উড়িয়ে পঞ্চায়েতের পাশে দাঁড়িয়েছেন এলাকার তৃণমূল নেতা উজ্জ্বল ঘোষও। তাঁর দাবি, ‘‘পঞ্চায়েতে ১৫ অগস্টের আগে দিন কয়েক ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ ছিল। তা নোটিস করে পঞ্চায়েতে টাঙানোও রয়েছে। আনাসরা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। প্রথম থেকেই ওঁদের নথিপত্র সম্পূর্ণ ছিল না। এখন ওঁদের ব্লক প্রাণিসম্পদ বিকাশ আধিকারিকের একটি নো-অবজেকশন সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে বলা হয়েছে।’’
তৃণমূলের ওই নেতা এবং পঞ্চায়েতের দাবির মধ্যে যে জল রয়েছে, তা ব্লক প্রাণিসম্পদ বিকাশ আধিকারিক শুভ্রমিত্র মজুমদারের কথাতেই পরিষ্কার। সব শুনে বিএলডিও বলছেন, ‘‘এমন করার পিছনে কী কারণ রয়েছে জানি না। তবে, এক জন ব্যবসা করতে চান। সব দেখে পঞ্চায়েত তাঁকে ট্রেড লাইসেন্স দেবে। তার সঙ্গে বিএলডিও-র সার্টিফিকেটের কোনও যোগ নেই। আমরা শুধু দেখব, প্রাণীটি সুস্থ আছে কিনা, টিকাকরণ প্রয়োজনীয় কিনা।’’