সিউড়ির সাজিনা গ্রামে লক্ষ্মীমূর্তি তৈরিতে ব্যস্ত কিশোর শিল্পী রণজিৎ পাল। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়
মাঝে মাত্র একটা দিন। শনিবার-ই কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো। মৃৎ শিল্পীদের ব্যস্ততাও তাই এখন তুঙ্গে। বহস্পতিবার সেই ব্যস্ততার ছবিই লক্ষ্য করা গেল সিউড়ির সাজিনা গ্রামে পালদের পরিবার গুলিতে। ছাঁচের তৈরি মূর্তি জন্য খ্যাত গ্রামের বেশ কয়েকটি পরিবার। শেষ বেলায় ছোট বড় নানা মাপের ও ছাঁচের লক্ষ্মী মূর্তিগুলিকে বাজারে পৌঁছে দিতে দেখা গেল সেই ব্যস্ততা। এই গ্রাম থেকেই লক্ষ্মী মূর্তি চলেছে পড়শি গ্রাম, জেলা ও জেলা ছাড়িয়ে পাশের জেলাতেও!
জেলায় হাতে গোনা দুর্গাপুজো উদ্যোক্তা বা মুষ্ঠিমেয় পরিবারে বড় লক্ষ্মী প্রতিমা হয়ে থাকলেও, বড় মূর্তির থেকে ছোট্ট ছাঁচে তৈরি লক্ষ্মীমূর্তির কদর অনেক বেশি। পুজোর একদিন আগে থেকে থেকেই বহরমপুর কৃষ্ণনগর, কলকাতা-সহ যে সব জায়গা থেকে আনা নানা ধরনের লক্ষ্মী মূর্তিতে বাজারে ছেয়ে যায়। গৃহস্থ মনের মত মূর্তি কিনে বাড়ি নিয়ে যান। সেই তালিকায় রয়েছে এই জেলার সিউড়ির সাজিনা গ্রামও। এ বারও অন্তত হাজার পাঁচেক ছাঁচের প্রতিমা পৌঁছে যাবে গৃহস্থের বাড়িতে বাড়িতে।
গ্রামে গিয়ে জানা গেল একসময় বাংলাদেশ থেকে আসা এক পাল পরিবারই গ্রামে এই মৃৎ শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে। পরিবার সূত্রে জানা গেল, সুরেন পাল ও পদ্মা পাল নামে এক দম্পতি ছয় দশক আগে সিউড়ি ২ ব্লকের পুরন্দরপুর পঞ্চায়েতের সাজিনা গ্রামে আসেন। ছাঁচের মূর্তিগড়ার কাজ তাঁরাই জানতেন। সুরেনবাবু অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। মাত্র ১১ দিন আগেই মারা গিয়েছেন পদ্মা পাল। মূলত ওই দম্পতির ছেলে মেয়েদের পরিবারই এখন এই শিল্পেকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। বংশ পরম্পরায় ছাঁচের মূর্তি তৈরিকেই জীবীকা করছেন। তাঁদের কাছ থেকে শিখে এখন ছাঁচের মূর্তি গড়েন গ্রামের আরও কয়েকটি পরিবার। বড় ছেলে রতন পাল, মেজ ছেলে সুবল পাল, মেয়ে গৌরী পাল, আরতী পাল প্রত্যেকের কারখানায় ঘুরে দেখা গেল নানা আকারের শয়ে শয়ে ছাঁচের মূর্তিতে ভরে রয়েছে। কোনওটা শুধু লক্ষ্মী, কোনওটা লক্ষ্মী-নারায়ণ। কোনওটার মাপ ছয় ইঞ্চি তো, কোনও মূর্তির আকার দু’ ফুটেরও উপরে। রতনবাবু-সুবলবাবুরা বলছেন, বিশ্বকর্মা থেকে শুরু। গণেশ গড়া পর্যন্ত চলতে থাকে কাজ। তবে বিশ্বকর্মা থেকে এটাই মরসুম। কারিগরেরা বলছেন, জেলার রামপুরহাট, সিউড়ি, কীর্ণাহার, দুবরাজপুরেই নয়, ছাঁচের তৈরি মূর্তি পৌঁছে যায় আসানসোল, পাণ্ডবেশ্বরেও।
কিন্তু যে ভাবে দিনে দিনে এই শিল্পের ভবিষ্যত অন্ধকারের দিকে এগোচ্ছে, তাতে বিকল্প পেশার দিকে ঝুঁকতে চাইছে ভবিষ্যত প্রজন্ম।
রতনবাবুর ছেলে রণজিৎ পাল যিনি উচ্চমাধ্যমিকের পরে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, অথবা বা গৌরীদেবীর মেয়ে সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে থেকে স্নাতক সান্ত্বনা পাল এখনও মন দিয়ে পরিবারের জীবিকার সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা বলছেন, ছাঁচ তৈরি। সেই ছাঁচে ঢেলে মূর্তি তৈরি করা, শুকানো, রঙ করা যথেষ্ট খাটনির। মূর্তির দাম পাইকারি বাজারে সাত টাকা থেকে শুরু করে ১০০-১২০ টাকা। যে ভাবে চাহিদার তুলনায় যোগান বাড়ছে বর্তমানে মার্কেট থেকে লাভ হচ্ছে না। তাই পেশা বদল করতে চান তাঁরা।
রতনবাবুর আরেক ভাই বিশ্বজিৎ পাল। যিনি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়া সত্বেও এতকাল ছাঁচের মূর্তি গড়তেন। তিনিও গত একবছর আগে মুদিখানা দোকান করেছেন। অন্যদিকে এতটা হতাশার কিছু দেখছেন না সুবলপাল বা তাঁর ছেলে গোপাল পালেরা। বলছেন, ‘‘বহুকাল ধরে এই কাজ করছি। ঠিক মতো ব্যবসা করতে পারলে লাভ হবেই। লাভ না থাকলে অন্যরা সেটা করছে কীভাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy