Advertisement
০৪ মে ২০২৪

মেটেলডাঙার মান রাখল সুমি, খুকুমনিরা

সব্বাই ধন্য ধন্য করছে। খুশিতে ডগমগ হয়ে বলছে— ‘‘এত দিনে গাঁয়ের মুখ উজ্জ্বল হল।মহল্লার লোকেরা তড়িঘড়ি সংবর্ধনা দিয়েছে। পোশাক, স্কুল ব্যাগ, মিষ্টির প্যাকেট, ৫০০ টাকার চেকও। সঙ্গে আগামী দিনে যাবতীয় সাহায্যের প্রতিশ্রুতি।

মাধ্যমিক উত্তীর্ণদের চোখে খুশির ঝিলিক।— নিজস্ব চিত্র।

মাধ্যমিক উত্তীর্ণদের চোখে খুশির ঝিলিক।— নিজস্ব চিত্র।

অর্ঘ্য ঘোষ
ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৬ ০২:১৪
Share: Save:

সব্বাই ধন্য ধন্য করছে। খুশিতে ডগমগ হয়ে বলছে— ‘‘এত দিনে গাঁয়ের মুখ উজ্জ্বল হল।’’

মহল্লার লোকেরা তড়িঘড়ি সংবর্ধনা দিয়েছে। পোশাক, স্কুল ব্যাগ, মিষ্টির প্যাকেট, ৫০০ টাকার চেকও। সঙ্গে আগামী দিনে যাবতীয় সাহায্যের প্রতিশ্রুতি।

কেন? — কয়েক দশক পরে গ্রামের কেউ প্রথম মাধ্যমিক পাশ করেছে যে! তা-ও এক, দু’জন নয় একেবারে পাঁচ জন! চাড্ডিখানি কথা?

বীরভূমের ময়ূরেশ্বরের আদিবাসী অধ্যুষিত ছোট্ট গ্রাম মেটেলডাঙা। ২৪টি পরিবারের বাস। প্রায় সকলেরই জীবিকা দিনমজুরি। জেলা শিক্ষা দফতরের একটি সূত্রে খবর, আর পাঁচটা পিছিয়ে পড়া গ্রামের মতো ওই গ্রামের ছেলেমেয়েরা প্রথম দিকে কিছু দিন স্কুলে যাওয়া আসা করে। কিন্তু বাড়িতে দেখিয়ে দেওয়ার কেউ না থাকায় পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়তে পড়তে মাধ্যমিকের গণ্ডী পেরোনোর আগেই স্কুলছুট হয়ে যায়। অধিকাংশই শিশু শ্রমিকে পরিণত হয়। সেখানেই পথ দেখাল ওরা।

গত বছরে নিজেদের উদ্যোগে মাধ্যমিকে বসেও পাশ করতে পারেনি সুমি মাড্ডি, খুকুমনি টুডুরা। মল্লারপুর থেকে পরীক্ষার ফল জেনে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফেরে তারা। সেই কান্না নাড়িয়ে দেয় ওই গ্রামে দীর্ঘ দিন কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার সাধন সিংহকে। সুমিদের সমস্যার কথা শুনে তাদের মাধ্যমিকের গণ্ডী পার করানোর গুরুদায়িত্ব নেয় সংস্থা।

তারপরেই শুরু লড়াই। গ্রামেরই কমিউনিটি হলে সুমিদের জন্য খোলা হয় স্বেচ্ছা পাঠদান কেন্দ্র। সপ্তাহে চার দিন পড়ানোর দায়িত্ব নেন বিভিন্ন স্কুলের ৫ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা। প্রথম এবং প্রধান সমস্যা ছিল ভাষা। কারণ, শিক্ষকেরা কেউই সাঁওতালি জানেন না। ছেলেমেয়েদের ভাষা বুঝতে মারিয়া টুডু নামে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ এক আদিবাসী তরুণীকে দো-ভাষী নিয়োগ করা হয়। কাজ হয় অনেকটাই। এখন ওই কেন্দ্রে পড়ুয়া সংখ্যা ৫০ জন। এ বার তাদের ১১ জন মাধ্যমিকে বসেছিল। সকলেই উত্তীর্ণ হয়েছে। তার মধ্যে ৫ জনই মেটেলডাঙার। দু’বার অকৃতকার্য হওয়া মল্লারপুর গার্লস স্কুলের সুমি, খুকুমনিরা তাদের অন্য তম। পাশ করে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছে সরস্বতী মাড্ডির। সহপাঠীদের সুরে মল্লারপুর হাইস্কুলের মঙ্গল মুর্মু, সাহেব মাড্ডিরাও বলছে, ‘‘আরও পড়ব।’’

মেটেলডাঙা থেকেই এ বার মাধ্যমিকে বসতে চলেছে সনাতন মুর্মু, বাসন্তী টুডু। দাদা-দিদিদের সাফল্য উৎসাহিত করেছে তাদেরও। সব মিলিয়ে খুশিতে ডগমগ মেটেলডাঙা। বুধবার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে পাঁচ জনকে সংবর্ধনা জানানো হয়। পুরোভাগে ছিলেন স্থানীয় আদিবাসীরা। পোশাক, স্কুল ব্যাগ, মিষ্টির প্যাকেটের পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির জন্য দেওয়া হয় ৫০০ টাকার চেক। ওই সব সামগ্রী তুলে দেন গ্রামের সুফল হেমব্রম এবং বাবুলাল টুডু। তাঁরা বলছেন, ‘‘এত দিনে গ্রামের বদনাম ঘুচল। ভাবতেই পারিনি আমাদের ছেলেমেয়েরা মাধ্যমিক পাশ করতে পারবে।’’

স্বেচ্ছা পাঠদান কেন্দ্রের প্রধান শিক্ষিকা তথা মল্লারপুর বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা অর্চনাদাস ঘোষ জানালেন, মেটেলডাঙার পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম, গৃহশিক্ষক রাখার মতো আর্থিক সামর্থ্য কিংবা বাড়িতে দেখিয়ে দেওয়ার মতো কেউ না থাকায় পিছিয়ে পড়তে পড়তে ওরা স্কুলছুট হয়ে যায়। ভাষাগত কারণেও ওরা নিজেদের সমস্যার কথা সব সময় তুলে ধরতে পারে না। সব দিক মাথায় রেখেই ওদের মাধ্যমিক পাশ করানোর চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলাম। বলছেন, ‘‘আহামরি রেজাল্ট হয়তো ওরা করতে পারেনি। কিন্তু যে প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে ওরা পাশ করেছে তা মেধাবীদের থেকেই কোন অংশে কম নয়।’’

অভিভাবক কৃষাণ টুডু, রাম মুর্মরা জানান, সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর হাল। প্রাইভেট টিউটর রেখে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর সামর্থ্য কোথায়? স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পাশে ছিল বলেই গ্রামের বদনাম ঘুচল। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার সাধনসিংহ বলছেন, ‘‘সত্যিই ওদের লড়াই কুর্ণিশ করার মতো। আমরা ওদের পাশে আছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Madhyamik Candidates
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE