এই বাজারেই খুন হন চাঁদনি।—নিজস্ব চিত্র।
সকাল পৌনে দশটা বাজে। রবিবার। আদ্রার এক প্রান্তে রামমন্দির লাগোয়া সাপ্তাহিক হাট গমগম করছে। দুই সাগরেদ নিয়ে বিক্রেতাদের থেকে তোলা তুলছিলেন এক বৃহন্নলা। সুভাষ টুডু ওরফে বাবু রাম। এলাকায় সবাই চেনে চাঁদনি নামে। আচমকা যেন মাটি ফুঁড়ে এক যুবক সামনে চলে আসে। গায়ে লাল শার্ট। কেউ কিছু বোঝার আগেই পাইপগানের একটি গুলি ফুঁড়ে দেয় চাঁদনির শরীর।
সালটা ২০১৩। নভেম্বরের ১০ তারিখ। গুলি করেই পাশের রেল ইয়ার্ড ধরে চম্পট দেয় দুষ্কৃতী। হাতে পাইপগান উঁচিয়ে থাকায় কেউ আর পিছু ধাওয়া করতে সাহস করেননি। তার উপরে দিন দশের আগেই সন্ধ্যায় ভরা বাজারে সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত এক যুবককে পরপর গুলি করে খুন করা হয়েছিল। তার রেশ কাটেনি তখনও। প্রকাশ্যে পরপর খুনের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে প়়ড়েছিল এলাকায়। তদন্তের প্রথমেই পুলিশ নিঃসংশয় হয়, গুলি চালিয়েছে ভাড়াটে খুনি। খুনের নেপথ্যে রয়েছে অন্য কেউ। পুলিশ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘটনার কয়েক মাস আগেও বাঁকুড়ায় চাঁদনির উপরে হামলা চালিয়েছিল বৃহন্নলাদের অন্য একটি গোষ্ঠী। তদন্তে উঠে আসে চাঁদনির বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতা রাজা খান ওরফে রীনা খাতুনের নাম। তার সঙ্গে প্রকাশ্যেই চাঁদনির বিবাদের সাক্ষী ছিলেন অনেকে। ঘটনার দিন পনেরো পরে গ্রেফতার করা হয় রীনাকে। তার পরে একে একে গ্রেফতার হন তাঁর দুই সাগরেদ শেখ ইমতিয়াজ ও মহম্মদ সাজ্জাদ।
পুলিশ জানাচ্ছে, চাঁদনি ওরফে সুভাষের বাড়ি ছিল আদ্রাতেই। অল্প বয়সে ভাল খেলোয়াড় হিসাবে এলাকায় নামডাকও ছিল। তারপর দীর্ঘদিন তাঁকে কেউ দেখেননি। একটু একটু করে সবাই যখন তার কথা ভুলতে শুরু করেছে, সুভাষ হঠাৎ ফিরে আসে। এ বার বৃহন্নলা রূপে, চাঁদনি নাম নিয়ে। পুলিশ জানতে পারে, মাঝের সময়টাতে সে মুম্বই চলে গিয়েছিল। আদ্রায় ফিরে চাঁদনি নিজের দল গড়ে তোলে। আর তাতেই আসন টলে রীনার।
কারও বাড়িতে সন্তান হলে সেখানে গিয়ে ঢোলক বাজিয়ে, নাচ করে গৃহস্থের টাকা নিত রীনার দল। কিন্তু তাঁদের দাবি দশ-বিশ, এমনকী তিরিশ হাজার টাকা পর্যন্ত গিয়ে থামত। তার উপরে ছিল এলাকার ব্যবসায়ীদের থেকে তোলা আদায়। বাজার থেকে সব্জি তোলা। একচেটিয়া সেই কারবার সঙ্কটের মুখে পড়ে যায় চাঁদনি চলে আসায়। প্রতিযোগী ময়দানে নামায় দাপট কমে রীনার। তোলা আদায়ের রাশও বেশ কিছুটা হাতছাড়া হয়। দলেও আসে ভাঙন। রীনার সাগরেদদের অনেকেই গিয়ে যোগ দেয় চাঁদনির সঙ্গে।
এই খুনের তদন্তে একাধিক বার তদন্তকারী অফিসার বদল হয়েছে। তাঁদেরই একাংশের থেকে জানা গিয়েছে, রীনার আদত বাস ছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার জগদ্দলের কাঁকিনাড়ির গুপ্তিপাড়ায়। আদ্রায় সে আদতে বহিরাগত। অন্যদিকে চাঁদনি আদ্রারই লোক। বৃহন্নলাদের সঙ্গে পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে থাকা অপরাধীদের দলগুলিও তাই চাঁদনির দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। তদন্তের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমনই এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, ‘‘গৃহস্থদের উপরে রীনা যে চাপ দিত চাঁদনির দৌলতে তা অনেকটাই কমে যায়। এলাকার পুরো দখলটাই একটু একটু করে চলে আসছিল চাঁদনির হাতে। সম্ভবত, সে জন্যই পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল রীনা।’’
এই সমস্ত তথ্য ও সূত্রগুলি মিলিয়ে খুনের মামলার নথি তৈরি করে পুলিশ। রীনা এবং তার দুই সাগরেদের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করা হয় আদালতে। তবে পরে ধৃত তিন জনই জামিন পেয়ে যান। পুলিশ জানিয়েছে, মাস চারেক আগে মামলাটির বিচার শুরু হয়েছে।
কিন্তু এখনও যায়নি সমস্ত আঁধার। মামলার আইনজীবীদের একাংশ এবং পুলিশ আধিকারিকরা জানান, মূল সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার করা হলেও খুনে ব্যবহৃত অস্ত্র পাওয়া যায়নি এখনও। সুপারি কিলার দিয়ে খুন করা হয়ে থাকলে ধরা যায়নি তাকেও। তাকে কোথা থেকে আনা হয়েছিল, কত টাকায় রফা হয়েছিল, খুনের পরে রেল ইয়ার্ড ধরে স্টেশনের দিকে আততায়ীর সঙ্গে মিলিয়ে গিয়েছে সেই প্রশ্নগুলির উত্তরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy