Advertisement
E-Paper

দুই অশোকের খুন আজও শাসকের কাঁটা

দু’টি খুনের মধ্যে ব্যবধান ছিল ঠিক এক বছর— ৩৬৯ দিনের। তবে খুনের কায়দাটা ছিল অবিকল এক। পুলিশের দাবি ছিল, আততায়ীরা এসেছিল মোটরবাইকে। ‘টার্গেট’-এর কাছে পৌঁছে রিভলভারের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় শরীর। দু’টি খুনেই সুপারি কিলার কাজে লাগানো হয় বলে তদন্তে জানতে পারে পুলিশ।

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৬ ০২:১৫

দু’টি খুনের মধ্যে ব্যবধান ছিল ঠিক এক বছর— ৩৬৯ দিনের। তবে খুনের কায়দাটা ছিল অবিকল এক। পুলিশের দাবি ছিল, আততায়ীরা এসেছিল মোটরবাইকে। ‘টার্গেট’-এর কাছে পৌঁছে রিভলভারের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় শরীর। দু’টি খুনেই সুপারি কিলার কাজে লাগানো হয় বলে তদন্তে জানতে পারে পুলিশ।

এই দু’জনের প্রথম জন খয়রাশোলের প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা অশোক ঘোষ। অন্য জন তৃণমূলের খয়রাশোলের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি অশোক মুখোপাধ্যায়।

২০১৩ সালের ১২ অগস্ট এবং ২০১৪ সালের ১৬ অগস্ট খয়রাশোলে তৃণমূলের বিবাদমান গোষ্ঠীর দুই নেতার হত্যা তোলপাড় ফেলে জেলা রাজনীতিতে। তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দলেই ওই খুন এবং পাল্টা খুন বলে দাবি ছিল বিরোধীদের। বহু আগে চার্জশিট জমা হলেও দুটি হত্যাকাণ্ডের বিচার এখনও শুরু হয়নি বলে জানিয়েছেন জেলার সরকারি কৌঁসুলি রণজিত গঙ্গোপাধ্যায়।

এ বারের বিধানসভা ভোটের মুখে বিরোধী রাজনীতির চর্চায় সেই জোড়া অশোকের খুন। খয়রাশোল দুবরাজপুর বিধানসভার অন্তর্গত। গত বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের দাপট সত্বেও বীরভূমের যে আসনগুলিতে বামেরা জেতে দুবরাজপুর তার অন্যতম। জিতেছিলেন টানা পাঁচ বারের বিধায়ক ফব-র বিজয় বাগদি। এ বারও প্রার্থী তিনি-ই। ভোটের অঙ্ক এবং টানা জয়ের ফলে ‘বিজয় রথ’ এ বারও চিন্তায় রাখছে তৃণমূল প্রার্থী নরেশচন্দ্র বাউড়িকে। সিপিএম-সহ বিরোধী শিবির খয়রাশোলে ২০১১ সালের পর থেকে ছ’জনের খুন হওয়ার পরিসংখ্যান তুলে পরিবর্তনের জামানায় অশান্তির বাতাবরণকে ঢাল করে জোর প্রচারে নেমেছেন। এই প্রসঙ্গে উঠে আসছে দুই অশোকের খুনের ঘটনা! মুখে না মানলেও ওই প্রচার যে দলকে বিড়াম্বনায় ফেলছে তা কবুল করছেন এলাকার এক তৃণমূল নেতা।

• এক বছরের ব্যবধানে খুন হন দুই তৃণমূল নেতা অশোক ঘোষ এবং অশোক মুখোপাধ্যায়।
• খয়রাশোলের প্রভাবশালী নেতা অশোক ঘোষ খুনে নাম জড়ায় অশোক মুখোপাধ্যায়ের।
• দু’টি খুনেই সুপারি কিলার কাজে লাগানো হয় বলে তদন্তে জানতে পারে বীরভূম পুলিশ।
• এখন দু’টি ঘটনায় অভিযুক্ত এবং চার্জশিটে নাম থাকা সকলে জামিনে মুক্ত।
​• বিধানসভা ভোটের মুখে চর্চায় জোড়া অশোক খুন।

পুলিশের বক্তব্য ছিল, দুই নেতার দ্বন্দ্বের মূলে ছিল খয়রাশোলের কয়লা সাম্রাজ্যের দখল এবং পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি-সহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্তৃত্ব বজায় রাখা। সেই বিরোধ চূড়ান্ত আকার নেয় গত পঞ্চায়েত ভোটের পরে। তৃণমূলের এক জেলা নেতাও মানছেন, ‘‘ভোটের পরে দখলে আসা সিংহ ভাগ পঞ্চায়েতের প্রধান, উপপ্রধান কে প্রধান হবেন তা নিয়ে প্রবল দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল দুই অশোকের মধ্যে। ওই বিরোধের সূত্রপাত সেখানেই।’’

সে দিন কী ভাবে খুন হন খয়রাশোলের কেন্দ্রগড়িয়া উচ্চবিদ্যায়ের শিক্ষাকর্মী অশোক ঘোষ? পুলিশ জানায়, কেন্দ্রগড়িয়ার বাসিন্দা হলেও পরিবার থাকত সাঁইথিয়ায়। সে দিন বাড়ি ফেরার জন্য ট্রেন ধরতে যাচ্ছিলেন। সেই সময় তাঁকে ধাওয়া করে একটি মোটরবাইক। চূড়োর গ্রামের কাছে পথ আটকে খুব কাছ থেকে গুলি করে খুন করা হয় তাঁকে। ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই অস্ত্র-সহ পাণ্ডবেশ্বরে স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে ধরা পরে অনুজ সিংহ এবং আলামত আনসারি নামে দুই যুবক। পরে বাসিন্দারা তাঁদের পুলিশের হাতে তুলে দেন। পরে খয়রাশোল থানা এলাকা থেকে কালীচরণ দাস নামে পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য, অনুদয় বাউড়ি, শেখ সেলিম নামে আরও তিন যুবককে গ্রেফতার করে। তৎকালীন জেলা পুলিশ সুপার মুরলীধর শর্মা বলেছিলেন, ‘‘সেলিমই মূল চক্রী। সেলিমকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে এই খুন করানো হয়েছে।’’

স্থানীয় নেতাকর্মী এবং মৃতের পরিবারের দাবি ছিল, তৎকালীন ব্লক সভাপতি অশোক মুখোপাধ্যায় ও নেতৃত্বের একাংশ ভাড়াটে খুনি দিয়ে খুন করিয়েছেন অশোকবাবুকে। ধৃতেরা ছাড়া অশোক মুখোপাধ্যায়, তাঁর ভাই রজত-সহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়। আর কেউ গ্রেফতার হননি। নিহতের পরিবারের অভিযোগ, জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় সুবাদেই অভিযুক্তদের ধরেনি পুলিশ। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি জেলা জজের কাছে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জানান সরকারি আইনজীবী রণজিত গঙ্গোপাধ্যায়। সেই সুযোগে সকালেই জামিন পেয়ে যান। অশোক ঘোষের স্ত্রী বিজয়াদেবী ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গেলেও সে ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।

অন্য দিকে, ২০১৪ সালের ১৬ অগস্ট রাত ৮টা ২০ নাগাদ ফল কিনতে বেরিয়ে বাড়ি থেকে একশো মিটার দূরে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন অশোক মুখোপাধ্যায়। এ বার অভিযোগের আঙুল ওঠে অশোক ঘোষের সে সময়ের অনুগামীদের বিরুদ্ধে। দু’টি মোটরবাইকে পাঁচ দুষ্কৃতী ওই হামলা চালায় বলে অভিযোগ। পরের দিনই অশোক গোষ্ঠীর নেতাকর্মী ও অনুগামী মিলিয়ে ৪৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন অশোক ঘোষের ভাই দীপক, ছেলে বিশ্বজিৎ, অজিত ধীবর-সহ তৃণমূলের অনেকেই।

তদন্তে নেমে পুলিশ ভাড়াটে খুনি সন্দেহে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে। শেষ পর্যন্ত, গত বছরের ৫ ডিসেম্বর ১৮ জনের বিরুদ্ধে দুবরাজপুর আদালতে চার্জশিট জমা দেয় পুলিশ। নাম ছিল দীপক, বিশ্বজিৎ, প্রলয় চট্টোপাধ্যায়, অজিত ধীবরদের। বিশ্বজিৎ আগেই জামিন পেয়েছেন। পরে একে একে অত্মসমর্পণ করেন দীপক ও অজিতেরা। জামিনও পান। এখন দুটি ঘটনায় অভিযুক্ত এবং চার্জশিটে নাম থাকা সকলে জামিনে মুক্ত।

আইনজীবীরা বলছেন, যেহেতু অশোক ঘোষ খুনে অন্যতম অভিযুক্ত আর এক অশোক নিজেই খুন হন তাই বিজয়াদেবীর করা জামিনের বিরোধিতা করে উচ্চ আদালতের শুনানি বাকি। সে কারণেই মামলাগুলি নিম্ন আদালতে আটকে রয়েছে। আবার দুই অশোকের পরিজনেরা অভিযুক্তের মধ্যে রয়েছেন। চার্জশিটেও তাঁদের নাম রয়েছে।

পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, এই পরিস্থিতিতে বিকল্প রাস্তাও খুঁজছেন উভয়পক্ষ। যদিও নিহত অশোক ঘোষের স্ত্রী বিজয়াদেবী এবং অশোক মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী তৃপ্তিদেবী উভয়েই বলছেন, ‘‘অপরাধীরা শাস্তি পাক। এটাই চাই।’’ দু’জনেই বিচার পেতে আস্থা রাখছেন আদালতে।

murder trinamool congress
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy