আদি চরিত্র হারিয়ে শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা ক্রমশ ব্যবসার জায়গা হয়ে উঠেছে বলে মনে করছে দেশের জাতীয় পরিবেশ আদালত।
মঙ্গলবার পৌষমেলায় দূষণ নিয়ে দায়ের হওয়া একটি মামলায় পরিবেশ আদালতের আরও পর্যবেক্ষণ, ওই মেলা বর্তমানে দখল নিয়েছে অসৎ লোকেরা। শুধু তা-ই নয়, কেন ওই মেলা বন্ধ করা হবে না, সে প্রশ্নও তুলেছেন বিচারপতি এস পি ওয়াংদি এবং বিশেষজ্ঞ সদস্য পি সি মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ। এ ব্যাপারে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষকে হলফনামা জমা দেওয়ার নির্দেশও দিল আদালত। হলফনামা চাওয়া হয়েছে রাজ্য সরকার, শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন উন্নয়ন পর্ষদ এবং বোলপুর পুরসভার কাছ থেকেও। এ দিনের আদালতের পর্যবেক্ষণের কথা জেনে বিশ্বভারতীর প্রবীণ আশ্রমিক সুপ্রিয় ঠাকুর বলেন, ‘‘বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগজনক। মেলায় যে পরিমাণ দূষণ হয়, তা অবশ্যই দূর করা দরকার। ওই সময় দূষণের জেরে মেলার আশপাশের বাসিন্দারা খুবই সমস্যায় পড়েন।’’
ঘটনা হল, পৌষমেলাকে কেন্দ্র করে বিশ্বভারতী চত্বরে কয়েক লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। সেই সময়ে পরিবেশ বিধির তোয়াক্কা না করে প্লাস্টিক জড়ো করা হয়, ডি়জেল জেনারেটর চালানো হয় বলে অভিযোগ। অথচ মেলা শেষে কঠিন বর্জ্য ঠিক ভাবে নষ্টও করা হয় না। জড়ো করে পুড়িয়ে দেওয়ার ফলে তার থেকে আরও বেশি দূষণ ছড়ায়। এমন সব অভিযোগ নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলা দায়ের করেছিলেন পরিবেশ কর্মী সুভাষ দত্ত।
ওই মামলায় গত মে মাসেই হলফনামা দিয়ে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিলেন, শান্তিনিকেতন ট্রাস্টের দায়িত্বে ৭-৯ পৌষ- এই তিন দিন সরকারি ভাবে মেলা হওয়ার কথা। কিন্তু তার পরেও আরও ১০-১২ দিন ধরে মেলা চলে। ওই সময়ের মেলায় বিশ্বভারতী ও শান্তিনিকেতনের ট্রাস্ট জড়িত থাকে না। তখন যে সেখানে ডিজেল জেনারেটার চলে এবং দূষণ হয়, তা গত ১১ মে আদালতকে দেওয়া হলফনামায় মেনে নেয় বিশ্বভারতী। তারা আরও জানিয়েছিল, কঠিন বর্জ্য নষ্ট করার মতো কোনও ব্যবস্থাও তাদের নিজেদের নেই।
এ দিন আদালতে বিশ্বভারতীর পাশাপাশি শান্তিনিকেতন ট্রাস্টও একটি হলফনামা জমা দিয়েছে। তাতে ট্রাস্টও একই দাবি করেছে। ট্রাস্টের আরও দাবি, অতিরিক্ত ১০-১২ দিন মেলা চলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন ও অন্যান্য কাজের যথেষ্ট অসুবিধাও ঘটে। পরিবেশবিদেরা বলছেন, পৌষমেলার মাঠে যা জনসমাগম হয় তাতে প্রচুর বর্জ্য তৈরি হওয়ার কথা। সেই বর্জ্য ঠিক মতো নষ্ট না করা হলে তা দূষণকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। খোলা জায়গায় প্লাস্টিক-সহ কঠিন বর্জ্য পোড়ালে তা বায়ু দূষণের মাত্রা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। সে ক্ষেত্রে কোনও নিয়ম না মেনে এত দিন কীভাবে মেলার আয়োজন হয়ে চলেছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশবিদেরা।
এ ক্ষেত্রে পরিবেশকর্মীদের বক্তব্য, মেলা হলে লোক সমাগম হবেই, ধুলো উড়বে, জমবে নানা ধরনের বর্জ্যও। তার ফলে মেলা করতে হলে কয়েকটি বিধি মানতেই হবে। এ নিয়ে পরিবেশ দফতরের নির্দিষ্ট নির্দেশিকাও রয়েছে। ওই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ৪০ মাইক্রনের থেকে পাতলা এবং নির্দিষ্ট মাপের ছোট ক্যারিব্যাগ নিষিদ্ধ থাকবে। শব্দসীমা মেনে মাইক বাজাতে হবে। ধুলো কমাতে জলের স্প্রিংকলার রাখতে হবে। গাছে আলো লাগানো যাবে না। কঠিন বর্জ্য নষ্ট করার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্য নিতে হবে। বর্জ্য পোড়ানো চলবে না। মেলা শেষে মাঠ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হবে। ওই নির্দেশিকায় জেলা ও স্থানীয় প্রশাসনকে বলা হয়েছে, মেলা করতে গেলে ওই পরিবেশবিধি মানতে হবে। বিধি না মেনে মেলা করলে অনুমতি মাঝপথেও তুলে নিতে পারে প্রশাসন। পাশাপাশি নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেও পারে।
আগের মতোই এ দিনও সুভাষবাবু অভিযোগ করেছেন, ‘‘অতিরিক্ত দিনগুলিতে বেআইনি ভাবে মেলা চললেও বীরভূমের পুলিশ-প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকে।’’ বহু চেষ্টা করেও প্রতিক্রিয়া মেলেনি বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য স্বপন দত্তের। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলেও শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান তথা মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ বলেন, ‘‘আদালত যা নির্দেশ দেবে, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ বোলপুরের তৃণমূল পুরপ্রধান সুশান্ত ভকত বলেছেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত আদালতের কোনও নির্দেশ হাতে পাইনি। তার আগে কিছু বলা ঠিক হবে না।’’ পরবর্তী শুনানি আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy