Advertisement
০৬ মে ২০২৪

নির্মল হতে অনেক পথ চলা বাকি

ঘরে ঘরে শৌচাগার তৈরি করতে পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধিদের পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। এ বার সেই জেলা পুরুলিয়ায় কাজের মূল্যায়ন করতে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানতে পারলেন, এখনও জেলার অধিকাংশ মানুষই শৌচকর্ম করতে সেই মাঠেই যাচ্ছেন।

শৌচাগার এখন গুদামঘর। হুড়ার ভাগাবাঁধ গ্রামে। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।

শৌচাগার এখন গুদামঘর। হুড়ার ভাগাবাঁধ গ্রামে। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

ঘরে ঘরে শৌচাগার তৈরি করতে পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধিদের পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। এ বার সেই জেলা পুরুলিয়ায় কাজের মূল্যায়ন করতে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানতে পারলেন, এখনও জেলার অধিকাংশ মানুষই শৌচকর্ম করতে সেই মাঠেই যাচ্ছেন।

মিশন নির্মল বাংলা প্রকল্পে কোনও ব্লকে ১৯ শতাংশ, কোনও ব্লকে ২৪ শতাংশ, কোনও ব্লকে ২৮ শতাংশ পরিবারে বাড়িতে শৌচাগার তৈরি হয়েছে। এমন হাল দেখে এই প্রকল্পে জেলা প্রশাসনকে কাজে আরও গতি আনার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন তিনি।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১২ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী সে বার থেকেই জেলার ২০টি ব্লকে শৌচাগার বিহীন বাড়িতে শৌচাগার গড়ার কাজ শুরু হয়। কিন্তু চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত এই কাজের গড় ৪০ শতাংশের উপরে তোলা যায়নি। ২০১২ সালে প্রশাসন জেলা ব্যাপী একটি সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষার পোশাকি নাম ছিল ‘বেস লাইন সার্ভে’। সেই সমীক্ষায় উঠে আসে জেলার ২০টি ব্লকের ৫ লক্ষ ৪৫ হাজার ৫৪০টি বাড়িতে কোনও শৌচাগার নেই। শৌচকর্মের ওই প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ পরিবারের ভরসা ছিল খোলা মাঠ বা পুকুরের পাড়। বছর দুয়েকের বেশি কাজ শুরু হলেও এখনও অবধি ২ লক্ষ ১৯ হাজার ৬৫৭টি পরিবারে শৌচালয় গড়ে তোলা গিয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রের খবর।

কিন্তু বাস্তব চিত্র হল প্রায় দু’লক্ষ ২০ হাজার পরিবারে শৌচালয় গড়া হলেও তাঁদের একটা বড় অংশই আবার শৌচালয়ে যান না। কোথাও জলের অভাবে শৌচাগার ব্যবহার করা হয় না। কোথাও আবার পুরনো অভ্যাসবশত সেই মাঠেই বাসিন্দারা যাচ্ছেন। জেলা পরিষদের বন ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষ হলধর মাহাতোর কথায়,‘‘আসলে পরিবেশের সুরক্ষার জন্য নিয়মিত শৌচাগার ব্যবহার করার মানসিকতাই এখনও অনেক গ্রামের মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। খোলা মাঠে বা পুকুরে যাওয়ার অভ্যেস থেকে এই ধরনের মানুষজন এখনও বেরিয়ে আসতে পারছেন না।’’

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

কেন কাজে গতি আনা যায়নি? কাশীপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সৌমেন বেলথরিয়ার ব্যাখ্যা, ‘‘আগে যে সব প্রকল্পে বাড়িতে শৌচাগার তৈরি করা হতো, তাতে বরাদ্দ কম ছিল। কাজ করার পরে সরকারের কাছ থেকে টাকা পেতেও বেগ পেতে হতো। তাই ততটা আগ্রহ ছিল না উপভোক্তার, আগ্রহী হতেন না ওই কাজের দায়িত্বে থাকা লোকজনও।’’ প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, কোথাও স্বনির্ভর গোষ্ঠী, কোথাও এনজিও, কোথাও এজেন্সি শৌচাগার তৈরি করে দিচ্ছে। এখন সরকার ‘মিশন নির্মল বাংলা প্রকল্পে’ বরাদ্দ বাড়িয়েছে। একটা শৌচাগার গড়তে ১০ হাজার টাকা সরকার দিচ্ছে, আর ৯০০ টাকা উপভোক্তাকে দিতে হচ্ছে। কাজেই আগের থেকে বরাদ্দ বেড়ে যাওয়ায় এখন ভাল মানের শৌচাগার তৈরি করা যাচ্ছে। সেই সূত্র ধরে হুড়ার কেশরগড় পঞ্চায়েতের প্রধান ঠাকুরদাস পাতর বলছেন, ‘‘লোককে শৌচাগার করতে বলায় এখন আগের ভাল সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। আশাকরি আমরা এ বার অনেক বেশি লোককে মাঠে শৌচকর্ম করতে যাওয়া বন্ধ করতে পারব।’’

তবে সব সমস্যা এখনও কাটেনি। জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য কর্মাধ্যক্ষ উত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বীকারোক্তি, ‘‘প্রশাসনিক উদাসীনতা তো রয়েছেই। এ কথা স্বীকার করায় কোনও দ্বিধা নেই। এই প্রকল্পের জন্য নিয়মিত যে ভাবে বৈঠক হওয়া ও নজরদারির প্রয়োজন, তা এতদিন করা যায়নি। ব্লকস্তরে এই প্রকল্পের নোডাল অফিসার হিসেবে রয়েছেন যুগ্ম বিডিও। কিন্তু ব্লকে আলাদা কোনও কর্মী নেই। কাজেই এই প্রকল্পে নিচুতলায় নজরদারি কী ভাবে হবে?’’

ঘাটতি রয়েছে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়ার ক্ষেত্রেও। প্রশাসন সূত্রের খবর, গত আর্থিক বছরে সারা জেলায় নতুন শৌচাগার তৈরি হয়েছে মাত্র সাত হাজারটি। জেলায় পঞ্চায়েতের সংখ্যা ১৭০। অর্থাৎ সারা বছরে প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত গড়ে ৪২টি করে শৌচাগার তৈরি করেছে। লক্ষ্যমাত্র বেঁধে দিলে অনেক বেশি কাজ পাওয়া যেত। জেলার ২০টি ব্লকের মধ্যে ১৩টি ব্লক ৫০ শতাংশ শৌচাগারই তৈরি করতে পারেনি। জেলার গড় শৌচাগারের সংখ্যা ৪০ শতাংশ। ওই মাপকাঠির নীচে রয়েছে আড়শা, বলরামপুর, বান্দোয়ান, বরাবাজার, ঝালদা ১, ঝালদা ২, জয়পুর, কাশীপুর, মানবাজার ১, নিতুড়িয়া, পাড়া ও রঘুনাথপুর ১ ব্লক। উত্তমবাবু বলেন, ‘‘এই প্রকল্পের প্রচার হোক বা বাসিন্দাদের সচেতন করার ক্ষেত্রে কোথাও একটা ফাঁক রয়েই গিয়েছে।’’

জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আসলে একটা অভ্যাস থেকে মানুষকে আর একটা নতুন অভ্যাসে নিয়ে আসতে হবে। এটা একটা সামাজিক প্রকল্প। এতে সকলের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা প্রয়োজন। ফলে কিছুটা সময় তো লাগবেই। তবে সবাই আরও উদ্যোগী হয়েছেন। আশাকরি ভাল সাড়া মিলবে।’’ তবে অভ্যাস বদলানোর কাজে আগে শিশুদের সঙ্গে নিয়ে নামতে হবে বলে মনে করেন উত্তমবাবু। তিনি বলেন, ‘‘সোমবার বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীও সেই কথাই বলেছেন। প্রয়োজনে শৌচাগার ব্যবহার স্কুল থেকেই শিশুদের মধ্যে তৈরি করতে হবে।’’

সম্প্রতি জনপ্রতিনিধিদের এই প্রকল্প উৎসাহী করতে জেলাশাসক পুরস্কার ও তিরস্কার নীতি চালু করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীকে সে কথা জানান জেলাশাসক। তিনি জানান, যে জনপ্রতিনিধিরা নিজের গ্রামকে নির্মল করতে পারবেন, তাঁদের নিজের গ্রামের জন্য ১০ লক্ষ টাকার প্রকল্প দেওয়া হবে। আর যাঁরা পারবেন না তাঁদের নাম সর্বসমক্ষে প্রকাশিত করা হবে। জেলাশাসক বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বলে গিয়েছেন কাজে আরও গতি বাড়াতে হবে। এটাই সবাইকে মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE