Advertisement
০৬ মে ২০২৪

তিনি কথা বলতেই সবাই ঠান্ডা

যেখানে দলের লোকই বনমন্ত্রী। সেখানে তিনি তো একটা ফোন করলেই গাছ কাটা বন্ধ হয়ে যাবে। তা হলে! এমন সাত-পাঁচ ভাবছিলাম। এ নিয়ে কিছু বলতে যেতেই হাত নাড়িয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘‘তা বটে! সে সবই হবে। আগে জনতার মনটা সকলে জানুক।

সিপিএমের পুরুলিয়া জেলা কার্যালয়ে নকুল মাহাতোর মরদেহ। বুধবার।ছবি: সুজিত মাহাতো

সিপিএমের পুরুলিয়া জেলা কার্যালয়ে নকুল মাহাতোর মরদেহ। বুধবার।ছবি: সুজিত মাহাতো

কিশোর সাহা
শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০১:৫৭
Share: Save:

নকুল মাহাতো নেই। বুধ-সকালের খবরটা হঠাৎই নিয়ে গেল পুরুলিয়ার সেই দিনগুলোতে। রুক্ষ পুরুলিয়া, অযোধ্যা পাহাড়ের পুরুলিয়া, আদিবাসীদের পুরুলিয়া এবং অবশ্যই নকুল মাহাতোর পুরুলিয়া।

শালবনের মধ্যে দিয়ে লাল মাটির রাস্তায় সাইকেলে স্কুলে পড়াতে যেতেন এক যুবক। কাউকে গাছ কাটতে দেখলে সাইকেল থামিয়ে তাঁর কাছে যেতেন। তাঁর হাতে বিড়ি দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দু’জনে কিছুক্ষণ সুখ-দুঃখের গল্প করতেন। এক ফাঁকে তাঁকে বোঝাতে শুরু করতেন, গাছ না কেটেও কী ভাবে জ্বালানি সংগ্রহ করা যায়। এ ভাবেই সেই ছোট্ট বনপথের দু’পাশের লোকজন তাঁকে চিনে ফেলেছিলেন। তাই কয়েক দশক পরে যখন হুড়ার ওই ছাতালালপুরের জঙ্গলের শালগাছ কাটার সরকারি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন এলাকার অনেকে ছুটে গিয়েছিলেন সেই মাস্টারের কাছে। বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ হে মাস্টার, তুমি তো এখন অনেক বড় নেতা বটে! গাছ কাটা চইলবেক না। ইটা দেইখতে হবে তুমাকে।’’

সময়টা নয়ের দশকের শেষের দিকে। পুরুলিয়ার নামোপাড়ায়, সিপিএমের জেলা পার্টি অফিসে এক রাতে আমাকে ডেকে পাঠালেন নকুল মাহাতো। তখন কর্মসূত্রে ডেরা বেঁধেছিলাম পুরুলিয়ায়। জানতে চেয়েছিলেন— ‘‘ছাতালালপুরের জঙ্গলে গেছ কখনও?’’ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলাম। তিনি প্রশ্ন ছুড়েছিলেন, ‘‘তা হলে বল, ওই সুন্দর শালের জঙ্গল কেটে ফেলাটা কি ঠিক হবে? ওই শালবন কাটা চলবে না। গাছ ‘ম্যাচিওর’ হয়েছে বলে সব কেটে ফেলতে হবে! না, এটা আটকাতে হবে। একটু গিয়ে দেখবে তো, লোকজন কী বলছে!’’

যেখানে দলের লোকই বনমন্ত্রী। সেখানে তিনি তো একটা ফোন করলেই গাছ কাটা বন্ধ হয়ে যাবে। তা হলে! এমন সাত-পাঁচ ভাবছিলাম। এ নিয়ে কিছু বলতে যেতেই হাত নাড়িয়ে আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘‘তা বটে! সে সবই হবে। আগে জনতার মনটা সকলে জানুক। দল-প্রশাসনের কাছে অনেক সময়ে মানুষের নাড়ির স্পন্দন ঠিকঠাক পৌঁছয় না হে।’’


বাড়ির উঠোনে খবরে চোখ।—ফাইল চিত্র

সে যাত্রায় ওই জঙ্গল নিয়ে একাধিক খবর হয়েছিল। এলাকার বাসিন্দাদের উদ্বেগ, ক্ষোভের কথা পৌঁছেছিল মহাকরণেও। বন দফতরের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী, পুরুলিয়ারই বাসিন্দা বিলাসীবালা সহিসের হস্তক্ষেপে ছাতালালপুরের অনেক শালগাছ বেঁচে গিয়েছিল।

তার কয়েক বছর পরের কথা। পুরুলিয়ায় নলকূপ কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে। এক দিন নকুলবাবুকে সব জানাই। বলেছিলেন, ‘‘আমি কলকাতায় যেখানে বলার বলে দেব। কেউ ছাড়া পাবে না।’’ ধারাবাহিক ভাবে অনেক খবর হয়েছিল। পরে কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার সাসপেন্ড হন। ঠিকাদারের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অনেকে রুষ্ট হন। যেখানে আমি থাকতাম, সেখানেও নানা ঝামেলা শুরু হয়। এক রাতে নকুলদা সেখানে এসে আমাকে ডেকে রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যান। তার পরে কেউ আর বিরক্ত করেনি।

ক’দিন পরে এক দুপুরে পার্টি অফিসে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘‘বেনোজল বোঝো! বেনোজলই ধাক্কা দিচ্ছিল তোমাকে।’’ আক্ষেপ করেছিলেন, ‘‘যে হারে বেনোজল ঢুকছে, তাতে বড় দুশ্চিন্তায় আছি।’’

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে পুঞ্চার ন’পাড়ার বাড়িতে নকুলবাবুর সঙ্গে শেষবার দেখা হয় ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের আগে। তাঁর আত্মজীবনী লেখার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আবেগপ্রবণ হয়ে অশীতিপর মানুষটি আমার হাত ধরে বলেছিলেন, ‘‘তোমাকে সময়ে-অসময়ে অনেক কথা বলেছি। এ সব কথা কখনও লিখ না কিন্তু। আমি মরে গেলেও সব কথা লিখবে না। কথা দাও।’’

কথা দিয়েছিলাম। তাই চোখের সামনে থাকা অনেকের সম্পর্কে অনেক কিছুই লেখা গেল না। সে প্রশংসা হোক বা নিন্দা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Purulia Nokul Mahato CPM
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE