Advertisement
E-Paper

দেদার বালি তুলে আলগা সেতুর ভিত

বিবেকানন্দ উড়ালপুলের স্মৃতি উসকে গেল ইলামবাজারে! নাহ্, কলকাতার বিবেকানন্দ উড়ালপুলের মতো নির্মীয়মাণ সেতু নয়। বরং প্রায় পাঁচ দশকের পুরোনো ইলামবাজার সেতু। অজয়ের বুকে ১১টি থামের উপরে দাঁড়িয়ে প্রায় ৩৫০ মিটার লম্বার পেল্লাই সেই সেতুতে চিড় নজরে এসেছে দিন কয়েক আগে, বুধবার সন্ধ্যায়।

মহেন্দ্র জেনা

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৬ ০০:৫০
ইলামবাজারের সেতুর পিলারের একেবারে গা থেকে বালি তুলে তুলে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। খটখটে অজয়ে জল শুধু সেখানেই। (ইনসেটে) সেতুতে যান নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞপ্তি। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

ইলামবাজারের সেতুর পিলারের একেবারে গা থেকে বালি তুলে তুলে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। খটখটে অজয়ে জল শুধু সেখানেই। (ইনসেটে) সেতুতে যান নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞপ্তি। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

সেতুটা ভেঙে পড়বে না তো!

বিবেকানন্দ উড়ালপুলের স্মৃতি উসকে গেল ইলামবাজারে! নাহ্, কলকাতার বিবেকানন্দ উড়ালপুলের মতো নির্মীয়মাণ সেতু নয়। বরং প্রায় পাঁচ দশকের পুরোনো ইলামবাজার সেতু। অজয়ের বুকে ১১টি থামের উপরে দাঁড়িয়ে প্রায় ৩৫০ মিটার লম্বার পেল্লাই সেই সেতুতে চিড় নজরে এসেছে দিন কয়েক আগে, বুধবার সন্ধ্যায়। তারপর থেকেই পানাগড়-দুবরাজপুর ১৪ নম্বর রাজ্য সড়কের ইলামবাজারের কাছে যান নিয়ন্ত্রণ করেছে পুলিশ।

তাতে আতঙ্কের কী আছে?

— সেতুর নীচে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা ছুড়তেই গম্ভীর মুখে সেতুর থামের দিকে আঙুল তুললেন লাগোয়া গ্রাম বনাঞ্চলের এক বাসিন্দা। বললেন, ‘‘ওই থামগুলোর অবস্থাটা দেখেছেন? থামের গা থেকে বালি তুলে তুলে ওর ভিতটাই আলগা করে দিয়েছে যে! অন্তত চার ফুট বেরিয়ে পড়েছে।’’ তাতে সায় দিলেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকে। তাঁরা বনাঞ্চল, বনভিলা, ভগবতীবাজার, নীলডাঙার বাসিন্দা। কথামতো অজয়ের গর্ভে নেমে দেখা গেল, সত্যিই সেতুর তিন নম্বর থাম থেকে শুরু করে পাঁচ নম্বর থাম পর্যন্ত মোট চারটে থামের নীচে বিশাল গর্ত। শুকনো অজয়ের কোথাও জল নেই। ব্যতিক্রম শুধু পিলারের গা। সেখান থেকে বালি তোলার জেরে হওয়া গর্তে দাঁড়িয়ে গিয়েছে জল।

শুধু ফাটল নয়, বেআইনি ভাবে দেদার বালির তোলার জন্য তার পিলারও কার্যত নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে বলে মত স্থানীয়দের। তাঁরা জানাচ্ছেন, বড় বড় গাড়ি গেলে সেতু যেন আগের চেয়ে একটু বেশিই নড়ে। এ সব কী জানা নেই প্রশাসনের? বীরভূমের জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীর সঙ্গে বহু চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। ধরেননি ফোন। জবাব দেননি এসএমএসের। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা অবশ্য বলছেন, ‘‘বিষয়টি নজরে এসেছে। দ্রুত পদক্ষেপ করা হবে।’’

বস্তুত, রাঢ়বঙ্গের এই জেলা নদী থেকে বালি তোলার বাড়বাড়ন্ত নতুন নয়। প্রশাসন সক্রিয় হলে কারবারে কিছুটা ভাটা পড়ে। ক’দিন যেতে না যেতেই যে কে সেই। জেলা প্রশাসনেরই একটি সূত্রে খবর, ইলামবাজার ব্লক, শীর্ষা, একডালা, শুকডালা, জয়দেব অঞ্চলের টিকরবেতা ও ভরাঙ্গি, ঘুড়িষা বীরভূমের দিকের গঙ্গাপুর ও নারায়ণপুর, ইলামবাজার পঞ্চায়েতের হকের বাগান, শিমুলতলা ঘাট, লেলেগড়, সাহেবডাঙা এলাকায় রয়েছে বৈধ ও অবৈধ বালির ঘাট। বোলপুর ব্লক এবং থানার রাইপুর-সুপুর পঞ্চায়েতের অবন সেতু লাগোয়া ঘেরোপাড়া, বাহিরী-পাঁচশোয়া পঞ্চায়েতের বড়শিমুলিয়া, সুলতানপুর, রসুলপুর, করিমপুর, রহমতপুর, সিঙ্গি, ঘি-দহ সিয়ান-মুলুক-সহ আরও কিছু এলাকা থেকেও তোলা হয় বালি। বালির ঘাটের আধিপত্য নিয়ে বোমা-গুলির লড়াইও নতুন নয়।

অনেকের মত, ট্রাকভর্তি বালি বোঝাই গাড়ির দাপটও সেতুর হাল খারাপের জন্যে দায়ি। কোনও গাড়ি ১৬ চাকার তো কোনওটা ২০ চাকার। সেতুর কম্পন বেড়েছে সে কারণেও। স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে জানা গেল, পথ সংক্ষেপ করতে বালিভর্তি গাড়িগুলির থামের মধ্যবর্তী রাস্তা ব্যবহার করে। নাগাড়ে গাড়ি যাতায়াতের ফলে সেই জায়গার বালি বসে যায়। আবার তার আশপাশ থেকেই বালি কাটা হয়। ফলে নদীতে জল হলে শক্ত জায়গায় বালির কিছুটা ধসেও যায়। বছরের পর বছর এমনটা চলায় ইতিউতি গর্ত হয় নদীতে। যার জন্যে দায়ি অবৈধ বালি তোলা।

২০১৫ সালের প্রথম দিকে দেদার বালি চুরির অভিযোগ পেয়ে সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় হানা দিয়েছিলেন অজয় নদের একাধিক বালি ঘাটে। বহু বালি তোলার গাড়িকে জরিমানা করা-সহ ঘাটের বালি তোলার যন্ত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়। ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে অবৈধ বালির ঘাটের দখলকে কেন্দ্র করে অজয় নদের লাগোয়া ইলামবাজার, বোলপুর এবং নানুর থানা এলাকার একাধিক জায়গায় সংঘর্ষও হয়। সেচমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন, পুলিশ, সেচ, ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের লোকজনকে নিয়ে টাস্ক ফোর্স গঠন করা হবে। মাঝে মধ্যে তাঁরা অভিযান চালিয়ে বেআইনি বালির ঘাট এবং বালির চোরাই কারবার বন্ধ করা হবে। বাস্তবে কিন্তু তেমনটা দেখা যাইনি বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি।

সেচ দফতরের এক ইঞ্জিনিয়রের কথায়, ‘‘সেতুর স্থায়িত্ব নির্ভর করে নজরদারির উপরে। কত গাড়ি যাবে, কতটা মাল পরিবহণ করা যাবে সে সবেরও নিয়ম থাকে। সেতুর ভিত মজবুত রাখতে থামের ২০০ মিটারের আশপাশ থেকে কোনও ভাবেই বালি তোলা যায় না।’’

কিন্তু, সে সব মানছে কে?

সেখানেই তৈরি হয়েছে ভয়। এই পরিস্থিতিতে অবিলম্বে সেতুর সংস্কার, সেতু সংলগ্ন এলাকা থেকে বালি তোলা বন্ধের কড়া পদক্ষেপের দাবি তুলেছেন স্থানীয়েরা। প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ১৯৬২ সালের ১৭ জুন অজয়ের উপরে এই সেতুর উদ্বোধন করেন। বীরভূমের সঙ্গে বর্ধমান তথা কলকাতার যোগযোগের অন্যতম মুখ্য রাস্তা পানাগড়-দুবরাজপুর ১৪ নম্বর রাজ্য সড়ক। ওই সড়কের উপরেই ইলামবাজারে রয়েছে অজয়ের সেতু। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরেও ওই সেতুতে ফাটল দেখা দেয়। দিন পনেরো সমস্ত রকমের যান চলাচল বন্ধ রেখে, সেতু সংস্কারের কাজ করে প্রশাসন। কিন্তু, আট মাস যেতে না যেতেই যে কে সেই! এখানেই ক্ষোভ।

রাঙামাটি বাস নিত্যযাত্রী সমিতির সভাপতি সুধাংশু ভাদুড়ির কথায়, ‘‘সেতু নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। পার হতে ভয় লাগে। অবিলম্বে বালি চুরি বন্ধ করে সেতু ঢেলে সংস্কার করা হোক।’’ পরিবহণ সমিতির জেলা নেতা কংগ্রেসের ফারুক আহমেদও একই দাবি তুলেছেন। তিনি বলছেন, ‘‘ওই সেতুতে চলাচল বাবদ দৈনিক প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা সরকারের ঘরে জমা দিতে হয়। তার উপরে ওই সেতুতে আকছার সংস্কারের কাজ চলে। ফলে প্রায়ই দুর্ভোগে প়়ড়তে হয়।

ঘুর পথে যেতে হয়। তাতে যাতায়াত খরচ বাড়ে।’’

Sand Bridge
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy