দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পর ৭ দিন পার হয়ে গিয়েছে। দিন তিনেক আগে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গড়ার কথাও ঘোষণা করেছে প্রশাসন। কিন্তু বুধবারও ময়ূরেশ্বরের ষাটপলশা পঞ্চায়েতে ১০০ দিন কাজের প্রকল্পে দুর্নীতির তদন্তে মাঠে নামতে দেখা যায়নি প্রশাসনের আধিকারিদের। এর ফলে প্রশাসনের সদিচ্ছা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। দ্রুত তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হলে শুধু শাসকদলের নেতা-কর্মীরাই নয়, বেশ কিছু সরকারি কর্মীরও ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে প্রশাসনেরই একাংশ। তাঁদের মতে, দুর্নীতির অভিযোগে সরকারি কর্মীদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে প্রশাসনেরও মুখ পুড়বে বলে তদন্তে ঢিলেমি করে আসলে তথ্য প্রমাণ লোপাটের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। প্রশাসন অবশ্য ওই অভিযোগ মানেনি।
তৃণমূল পরিচালিত ওই পঞ্চায়েতে দীর্ঘদিন ধরে ১০০ দিন কাজের প্রকল্পে মজুরদের পরিবর্তে যন্ত্র দিয়ে করানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জবকার্ড এবং পাশবই আটকে রেখে মজুরদের গোপন করে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ। গোটা ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হিসাবে উঠে এসেছে জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ জটিল মণ্ডলের ডান হাত হিসাবে পরিচিত স্থানীয় মনোহরপুর গ্রামের সুরথ মণ্ডল ওরফে বাপ্পার নাম।
ওই পঞ্চায়েত এলাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মজুরদের জন্য বরাদ্দ কাজ জটিলবাবুর ট্রাক্টর এবং ডোজার দিয়ে করিয়ে তাঁর প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে বাপ্পা। সেই সুবাদে পঞ্চায়েত এলাকায় একছত্র আধিপত্য কায়েমই শুধু নয়, ব্লক স্তরের আধিকারিকদের সঙ্গেও ভাল রকম দহরম মহরম গড়ে উঠে তাঁর। ব্লকের অন্যান্য পঞ্চায়েত এলাকার বহু কর্মী জানিয়েছন, আমরা কোনও প্রকল্প অনুমোদনের আর্জি নিয়ে গেলে দিনের পর দিন ঘোরানো হয়েছে। আর বাপ্পা গেলে গুরুত্ব সহকারে তা মঞ্জুর করে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আধিকারিকরা। আসলে বাপ্পার মাথায় জটিলবাবুর হাত তো রয়েইছে, ওইসব আধিকারিকদের সঙ্গেও রয়েছে গোপন বোঝাপড়া। তাই ১০০ দিনের প্রকল্পে বছরের পর বছর আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মজুরদের কাজ যন্ত্র দিয়ে করিয়ে নয়া মাত্রা যোগ করেছে বাপ্পা।
কিন্তু সম্প্রতি ওই দুর্নীতির পর্দা ফাঁস হয়ে যায়। স্থানীয় সুপারভাইজারদের মাধ্যমে চাপ দিয়ে বাপ্পার কাছে আটকে থাকা জবকার্ড এবং পাশবই আদায় করেন জবকার্ডধারীরা। দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি পাশবই থেকেই মজুরদের অন্ধকারে রেখে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। তারপর থেকেই ওই টাকা ফেরতের দাবিতে তেতে ওঠে প্রতিটি গ্রাম। জনরোষে পড়তে হয় পঞ্চায়েত প্রধান, সদস্য, সুপারভাইজারদের। চাপে পড়ে কোথাও নগদে টাকা ফেরানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই ক্ষোভের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। অন্যান্য গ্রামেও টাকা ফেরতের দাবিতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষোভের আঁচ থেকে বাঁচতে সুপারভাইজার, পঞ্চায়েত সদস্যদের গ্রাম ছাড়া হতে হয়। সব মহলে দাবি ওঠে তদন্তের। রবিবার অতিরিক্ত জেলাশাসক উমাশঙ্কর এস জানিয়েছিলেন, ওই বিষয়ে তদন্ত করার জন্য বিডিও-কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সোমবার পরিস্থিতির সামাল দিতে ষাটপলশায় এসে স্থানীয় বাসিন্দাদের টাকা ফেরানোর দাবির মুখে তৃণমূলের খোদ জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলও জানিয়েছিলেন, তদন্ত হবে। প্রশাসন উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে।
কিন্তু তারপরেও প্রশাসনের কোনও হেলদোল নেই বলে অভিযোগ। অথচ প্রশাসনেরই একটি অংশ জানাচ্ছে, এক্ষেত্রে তৎপরতার সঙ্গে সর্বাগ্রে নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করা উচিত ছিল। কারণ শুধু মজুরদের পাশবই থেকে টাকা তুলে নেওয়াই নয়, ভুয়ো জবকার্ড, পাশবই এমন কি মৃত ব্যক্তির নামেও টাকা তোলার সম্ভবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরই বাপ্পার বাড়িতে তল্লাশি চালানো হলে ওইসব জাল নথিপত্র পাওয়ার সম্ভবনা ছিল। সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কেও দুর্নীতির কিছু প্রমাণ পাওয়ার সম্ভবনা ছিল। কারণ ব্যাঙ্কে সইয়ের পাশাপাশি অনেকক্ষেত্রে টিপছাপ দিয়েও টাকা তোলা হয়। নির্দিষ্ট ফর্মে সই মিলিয়ে প্রাপকের পরিবর্তে প্রেরককে টাকা দেওয়ার নিয়ম থাকলে টিপছাপের ক্ষেত্রে প্রাপককে সশরীরে ম্যানেজারের সামনে টিপছাপ দিয়ে টাকা তুলতে হয়।
যোগসাজসের অভিযোগ অস্বীকার করে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বাবলু দত্ত বলেন, ‘‘তদন্তের জন্য কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। টিপছাপের ক্ষেত্রে সরাসরি প্রাপকদের টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে তাঁদের সেই টিপছাপ সম্বলিত ফর্ম কত দিন ব্যাঙ্কে রাখা হবে তা বলা যাবে না।’’ যদিও জেলা লিড ব্যাঙ্ক ম্যানেজার দীপেন্দু নারায়ণ ঠাকুর বলেন, ‘‘ওই সংক্রান্ত নথি প্রতিটি ব্যাঙ্কে কমপক্ষে ১০ বছর সংরক্ষণ করাটা বাধ্যতামূলক। ওই ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে কী হয়েছে বলতে পারব না।’’ ব্যাঙ্কের মতোই পঞ্চায়েতের যোগসাজসের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন পঞ্চায়েত প্রধান নন্দদুলাল দাস। বিজেপি’র ময়ূরেশ্বর ২ নং ব্লক মণ্ডল কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রবীর দাস বলেন, ‘‘আসলে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেড়িয়ে পড়তে পারে বলেই প্রশাসন তদন্তে ঢিলেমি করে নথিপত্র লোপাটের সুযোগ করে দিচ্ছে। ওই দীর্ঘ সূত্রিতাই শাসক দলের নেতা-কর্মী ছাড়াও সরকারি কর্মীদের একাংশেরও জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে।’’
অতিরিক্ত জেলাশাসক উমাশঙ্কর এস বলেন, ‘‘মহকুমা এবং ব্লক স্তরের আধিকারিকদের নিয়ে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তদন্তও শুরু করেছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy