Advertisement
E-Paper

জুলি-লক্ষ্মীর উপেক্ষার জ্বালা ভুলিয়ে দিল রাখি

সমাজের অবজ্ঞা আর উপেক্ষার জ্বালা সইতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল সেই কোন শৈশবে। তবু আজ ঘুরেফিরে সেই বাড়ির কথাই মনে পড়ে যাচ্ছিল জুলির। বারবার মনে হচ্ছিল, আজ যদি নিজের ভাইটাকেও রাখি পরিয়ে দিতে পারতাম।

অর্ঘ্য ঘোষ

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ০২:০৭
কাছের মানুষ। কীর্ণাহার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অন্য রকম ভূমিকায় বৃহন্নলারা। ছবি: সোমনাথ মু্স্তাফি।

কাছের মানুষ। কীর্ণাহার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অন্য রকম ভূমিকায় বৃহন্নলারা। ছবি: সোমনাথ মু্স্তাফি।

সমাজের অবজ্ঞা আর উপেক্ষার জ্বালা সইতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল সেই কোন শৈশবে। তবু আজ ঘুরেফিরে সেই বাড়ির কথাই মনে পড়ে যাচ্ছিল জুলির। বারবার মনে হচ্ছিল, আজ যদি নিজের ভাইটাকেও রাখি পরিয়ে দিতে পারতাম। শুধু জুলিই নয়, একই কথা মনে হচ্ছিল তাপসী, পাপিয়া-সহ আরও বারো জন বৃহন্নলারও।

শনিবার তাঁদের নিয়েই কীর্ণাহার বাসস্ট্যান্ডে গণরাখিবন্ধনের আয়োজন করেছিল স্থানীয় ‘আমরা ক’জন’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংস্থা। সকাল থেকেই তাই উৎসবের মেজাজে ছিল কীর্ণাহারের বাসস্ট্যান্ড এলাকা। বাসচালক থেকে চা দোকানি, খবরের কাগজ বিক্রেতা থেকে ভ্যানচালক— সবার হাতেই রংবেরঙের রাখিতে রঙিন। আর তাঁদের হাতে রাখি পরাতে পরাতেই দীর্ঘ নিশ্বাস চেপে রাখতে পারলেন না জুলিরা। এত দিন তাঁদের হাতে কেউ রাখি পরিয়ে দেয়নি। রাখি পরতে কেউ হাতও বাড়িয়ে দেয়নি।

বছর তিরিশের জুলির বাড়ি বর্ধমানের চাকটা গ্রামে। বাড়ি ছড়তে হয়েছিল মাত্র ১২ বছর বয়সেই। আবার বর্ধমানেরই আমগড়িয়ার বছর ৩৮-এর তাপসী বাড়ি ছেড়েছেন ১৫ বছর বয়সে। নদিয়ার চাপড়ার বছর চল্লিশের লক্ষ্মী ১০ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে এসেছেন। কিন্তু, বাড়ির কথা ভুলতে পারেননি আজও। সবার বাড়িতেই বাবা-মা, ভাই-বোন রয়েছে। তাঁদের টানে কেউ কেউ কালেভদ্রে বাড়ি ফিরলেও তিষ্ঠোতে পারেননি দু’দিনও। কেতুগ্রামের রাউন্দির সরলা, বর্ধমানের লক্ষ্মীপুরের পাপিয়ারা বলছেন, ‘‘একসময় সমাজের উপেক্ষা আর অবহেলার জ্বালা সইতে না পেরে ঘর ছেড়ে ছিলাম। পরে যখন বাড়ি ফিরি, তখন দেখি নিজের লোকের কাছেও আমরা অপাংক্তেয় হয়ে গিয়েছি। বাবা-মায়ের কাছে স্নেহ ভালোবাসা মিললেও ভাই-বোনেরা ভাল ভাবে কথাই বলত না। আমরা চাইতাম অন্যদের মতো ভাইবোনদের হাতে রাখি পরিয়ে দিতে।’’ কিন্তু, ভাইবোনেরা তাঁদের উপার্জনের টাকা নিতে কুণ্ঠা বোধ না করলেও রাখি পরতে কোন আগ্রহই দেখাতেন না। এমনকী, ভাইবোনের বিয়ে কিংবা কোনও অনুষ্ঠানে যাতে তাঁরা বাড়িতে না পৌঁছে যান, তার জন্য বিষয়টি তাঁদের জানানোই হয় না। এই সব আক্ষেপ নিয়েই বহু দিন আগেই বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন উপেক্ষিত পাপিয়ারা।

তাই প্রিয়জনদের কথা সদা মনে পড়লেও আর ঘরে ফেরা হয় না ওই বৃহন্নলাদের। ট্রেনে-বাসে ঘুরতে ঘুরতেই আলাপ পরিচয় হয় বারো জনের। বর্তমানে একত্রে ডেরা বেঁধেছেন কেতুগ্রামের নবস্থা গ্রামে। সকাল হলেই দু’তিন জন করে, কখনও বা একসঙ্গে বেরিয়ে পড়েন রোজগারে। কখনও বাসে-ট্রেনে ভিক্ষা, কখনও বা গৃহস্থের বাড়িতে নেচে যা পান, তা নিয়েই দিনের শেষে ডেরায় ফেরেন। তারপর রান্না চড়িয়ে ডুগি-তবলা বাজিয়ে গানের মধ্যে ভুলে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা। কাজল, শ্রীপাতরা বলেন, ‘‘সমাজের উপেক্ষা সইতে সইতে আমাদের অনেকেই রুক্ষ প্রকৃতির হয়ে পড়েন। তা ছাড়া নিজেদের রক্ষা করতেও আমাদের রুক্ষ ভাব দেখাতে হয়। যে সমাজ দিনের আলোয় আমাদের উপেক্ষা করে সেই সমাজই রাতের অন্ধকারে নানা অছিলায় আমাদের ডেরায় হামলে পড়ে।’’ তবে আজকের দিনটা ভীষণ উপভোগ করেছেন প্রত্যেকেই। তাই ভাইবোনদের কথাও ওঁদের খুব মনে পড়ছে। এ দিন যদিও তাঁদের হাতে রাখি পরানোর সাধ অপূর্ণই থেকে গেল জুলিদের।

এ দিকে, বৃহন্নলাদের হাতে রাখি পরে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত বাসচালক মানিক গড়াই, খালাসি মনোয়ার শেখ, ভ্যানচালক শেখ রবু কিংবা স্থানীয় তৃণমূল কর্মী রমেশ সাহারা। রাখির পাশাপাশি বৃহন্নলারা তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছেন একটি করে চকোলেটও। প্রতিদানে ভাইয়েরাও জুলিদের রাখি পরিয়ে কেউ খাইয়েছেন চা-বিস্কুট, কেউবা মিস্টি। তাই বৃহন্নলাদের মতোই আবেগে আপ্লুত মনোয়াররাও। তাঁদের কথায়, ‘‘সারা বছর সকাল থেকে রাত পরিবারের অন্ন জোগাড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। আমাদের জন্যও যে এমনটা হতে পারে, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।’’ পরিকল্পনা সফল করে মুখে হাসি স্থানীয় ‘আমরা ক’জন’-এরও। সংস্থার সভাপতি নীলেশ ঘোষ, সম্পাদক রানা দাসরা বলছেন, ‘‘বেশ কিছু দিন ধরে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ভিক্ষা করার সময় ওঁদের অধিকাংশ মানুষের অবজ্ঞা আর উপেক্ষার শিকার হতে দেখেছি। তখনই মনে হয়েছিল মানসিক দূরত্বই এর অন্যতম কারণ। সেই দূরত্ব কমাতেই রাখিবন্ধনের পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। তবে, এতটা সাড়া পাব, তা কিন্তু ভাবিনি।’’

Raksha Bandhan Kirnahar bardhaman Trinamool
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy