টানা বৃষ্টি ও ঝাড়খণ্ড থেকে জল ছাড়ায় টইটম্বুর অজয়। সোমবার দয়াল সেনগুপ্তের তোলা ছবি।
অন্ধকার নামার পরেই মনের মধ্যে ভয়টা চেপে বসছিল। সঙ্গীদের অবস্থা তখন আরও খারাপ। আদৌ বাড়ি ফেরা হবে কি না, এই সংশয়ে বারবার তাঁদের চোখে জল এসে যাচ্ছিল। মুখে ওঁদের সাহস দেওয়ার চেষ্টা করলেও নদীর জলের একটানা ছলাৎ ছালাৎ আওয়াজটা আমারও বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। বালির চর ডুবে গিয়ে একটু একটু করে উঠে আসছিল অজয় নদের জল। শেষে চরটাই ডুবে যাবে না তো! এই আশঙ্কাই সব থেকে বেশি হচ্ছিল। ওই চরেই যে আশ্রয় নিয়েছিলাম আমরা তিন জন। আমাদের সঙ্গে ছিল তিন জনের ৩টি সাইকেল এবং ছ’টি ছাগলও। এক এক মিনিট যেন অনেক বেশি সময় মনে হচ্ছিল। উপরওয়ালা যা চাইবেন, তাই হবে ভেবে নিয়ে যতটা সম্ভব নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছিলাম। তবুও বাড়িতে বৌ-বাচ্চার কথা বারবার মনে পড়ছিল। অবশেষে প্রায় ছয ঘণ্টা পরে রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ উদ্ধারকারী নৌকা এল।
রবিবার দুপুরে যখন অন্যান্য দিনের মতোই শিমূলডিহি গ্রামের বাড়ি থেকে ডিউটির জন্য বেরোলাম, এক বারও ভাবিনি এমন চরম দুর্ভোগ কপালে রয়েছে অজয় পেরোনোর পথে। বাড়ি থেকে কোটা ঘাট পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার মতো রাস্তা। সেখান থেকেই রোজ নৌকায় উঠি। অজয়ের মাঝ বরাবার একটা বড় চর রয়েছে। নৌকোয় সাইকেল চাপিয়ে অজয়ের মাঝের ওই চরে নেমে সেটা পেরিয়ে আবার অজয় নদ। হেঁটেই সেটা পেরিয়ে পৌঁছে যাই বর্ধমানের কাঁকসা থানার শ্রীরাম ঘাটে। গত এগারো বছর ধরে শীত-গ্রীষ্ম বার্ষা— এটাই আমার রুটিন। সেখানে মান্দারবুনিতে একটি কয়লাখনিতে নিরাপত্তা রক্ষীর দায়িত্বে রয়েছি। রবিবার বেলা আড়াইটে নাগাদ যখন নৌকো চড়লাম, তখন অজয়ের জল বেশ বেশি। আমার সঙ্গী কাঁকসার বাসুদেবপুর গ্রামের দুই ছাগল কারবারি। নাম নিত্যগোপাল ও শিবদাস মুখোপাধ্যায়। শিবদাসবাবুর সঙ্গে ছাগলগুলি ও দু’জনের দু’টি সাইকেল। কিন্তু, যেই চর পেরিয়ে ফের অজয়ের জলে নামতে যাব, দেখি বান এসেছে। ও পারের লোক জন বারণ করে বলল, ‘বাঁচতে চাও তো জলে নেমো না’। পিছিয়ে এ ধারে এসে দেখি নৌকো ফিরে গিয়েছে। আর নদীতে হঠাৎ-ই যেন দ্বিগুণ জল চলে এসেছে। তীব্র স্রোতের ভয়ে মাঝিরা আর আমাদের আনতে যেতে পারেনি।
উৎকণ্ঠার সেই শুরু। যেহেতু প্রতি দিন ডিউটিতে যাই। তাই সঙ্গে চর্ট, মোবাইল, বর্ষাতি ও একটা টিফিন ক্যারিয়ারে রাতের জন্য রুটি-সব্জি— সবই ছিল। সঙ্গী দু’জনের কাছে না ছিল মোবাইল, না অন্য কিছু। ভাগ্যিস মোবাইল ফোনটা সঙ্গে ছিল। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সেটার মাধ্যমে আমার এক আত্মীয়কে খবর দিই। খবর পান বাসুদেবপুরের লোকেরাও। এর পর প্রতীক্ষার শুরু। নদীর জল ক্রমশ বেড়ে চলেছে। বহু লোক আমাদের ফোন করে আশ্বস্ত করতে চাইলেও মন ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ছিল। ও পারের লোকেরা জেনারেটার দিয়ে নদীর ধারে দু’টি আলো লাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই মন ভাঙতে শুরু করেছিল। চরটাই তলিয়ে যাবে না তো! ভয়ের আরও কারণ, জলের স্রোতে ভেসে আসা সাপখোপ।
এ দিকে, সঙ্গীরা বারবারই হতাশ হয়ে পড়ছিলেন। তাঁদের এত দিনের নদী পেরোনোর অভিজ্ঞতা শুনিয়ে কিছুটা চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করছিলাম। অবশ্য সকলকেই বাড়িতে খবরটা জানাতে বারণ করেছিলাম। পাছে পরিবারের লোক চিন্তা করে। প্রায় ৮টা নাগাদ দুবরাজপুরের বিডিও-র ফোন পেলাম। তিনি বললেন, ‘‘ভয় পাবেন না। আমরা আপনাদের উদ্ধারের ব্যবস্থা করছি।’’ আর ছিলেন এলাকার লোকেরা। সাড়ে ৮টা নগাদ প্রশাসনের উৎসাহে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নৌকো করে ১২ জন এসে আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে গেলেন। এত বছর ধরে নদী পার করি। কখনও এমন দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা হয়নি। পৌনে ১১টা নাগাদ বাড়ি ফিরে আপনজনদের দেখে খুব ভাল লাগল। কাজ যখন করি, তখন রোজই অজয় পেরোতে হবে। তবে, নামার আগে ভাল করে খবর নিয়ে তবেই নদীতে নামব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy