Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

হাসপাতালে পুনর্জন্ম, কেক কাটলেন প্রবাল

শরিতাদেবী বলেন, ‘‘প্রবালের নতুন জন্মদিনে নার্সরা ওকে নতুন পাঞ্জাবি উপহার দিয়েছে। প্রবাল মাটির মূর্তি গড়ে, ভাল ছবিও আঁকে। ওঁকে বলেছি সুস্থ হয়ে নিজের কাজে মন দিতে।’’

উছ্বাস: পুরুলিয়া সদর হাসপাতাল থেকে ছুটির আগে। নিজস্ব চিত্র

উছ্বাস: পুরুলিয়া সদর হাসপাতাল থেকে ছুটির আগে। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০২:৩০
Share: Save:

এ যেন পুনর্জন্ম। এক মাস ভেন্টিলেশনে থাকা ছেলেটাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে আগাগোড়া দুর্ভাবনায় ছিলেন পরিজনেরা। বছর বাইশের সেই ছেলেকে হাসপাতাল সুস্থ করে ছুটি দিতেই উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে সবার মধ্যে। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সেবায় বছর বাইশের যুবক প্রবাল সিংহের পুনর্জন্মই হয়েছে বলে মনে করছেন তাঁর পরিজনেরা। মঙ্গলবার পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে তাই প্রবালের ছুটির আগে কেক কেটে, মিষ্টি বিলি করে জন্মদিন পালন করা হল।

ঝাড়খণ্ডের তামারের বাসিন্দা প্রবাল ছোট থেকেই তাঁর মামারবাড়ি পুরুলিয়া শহরের ভাগাবাঁধ পাড়ায় থাকেন। ১৪ ডিসেম্বর পেটের গোলমাল ও বমির উপসর্গ নিয়ে তাঁকে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথমে তাঁকে ডায়েরিয়া বিভাগে ভর্তি করা হয়। পরে এক ডাক্তারের পরামর্শে তাঁকে মেডিসিন বিভাগে স্থানান্তরিত করা হয়। সেই থেকে ছুটির আগে পর্যন্ত প্রবালের ঠিকানা ছিল হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট।

মেডিসিন বিভাগের ডাক্তার হিমাদ্রী পালের কথায়, ‘‘আমরা লক্ষ করি, ছেলেটির ‘অ্যাপনিয়া’ আছে। এতে শ্বাস-প্রশ্বাস সঙ্গে যুক্ত মাংস পেশিগুলি নিস্তেজ হয়ে যায়। চিকিৎসার পরিভাষায় বলা হয়ে থাকে, ‘রেসপিরেটরি মাসলস প্যারালিসিস’।’’ তাই প্রথম দিন থেকেই তাঁকে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে রাখা হয়। হিমাদ্রীবাবুর কথায়, ‘‘প্রবালের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। তাঁর সংজ্ঞা ছিল না। সে জন্য ওঁকে ভেন্টিলেশনে রাখতে হয়েছিল। দ্রুত গলায় অস্ত্রোপচার করা হয়। ট্রাকিওস্টোমি করে কৃত্রিম ভাবে শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। করা হয় ইটি-ও। শুরু হয় ওষুধপত্র।’’ তাঁকে সুস্থ করে তোলাটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম চিকিৎসকেরা। পাঁচ জন ডাক্তার, ১২ জন নার্স, সিসিইউ টেকনিসিয়ান থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা কার্যত দিনরাত এক করে কাজ করে গিয়েছেন।

কলকাতার ন্যাশনাল অ্যালার্জি অ্যাসমা ব্রঙ্কাইটিস ইনস্টিটিউশনের অধিকর্তা অলকগোপাল ঘোষাল বলেন, ‘‘অনেক সময় রেসপিরেটরি মাসলস প্যারালিসিস স্বাভাবিক ভাবে সেরে যায়। রোগীকে সেই সময়টুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্য ইটি, ট্রাকিওস্টোমি-র মতো অস্ত্রোপচার করে শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তবে রোগ জটিল হলে কিছু থেরাপি ও ওষুধ দেওয়া হয়।’’

চোখ মেলে কথা বলার অবস্থায় আসার পরে নার্সদেরই প্রবাল মা বলেই ডাকতে শুরু করেন। হাসপাতালের নার্সিং সুপার শরিতা পাল বলেন, ‘‘ওঁরা প্রত্যেকে মিলেই প্রবালের জন্য কী না করেছেন। সেটা উপলব্ধি করেই নার্সদের তিনি মা, মাসি বলতেন। তাই ওঁকে ছুটি দেওয়ার সময় নার্সেরা অঝোরে কাঁদছিলেন।’’

বিভাগের এক ডাক্তার কার্তিক পাতরের কথায়, ‘‘এ ভাবে ফিরে আসা পুনর্জন্মই বটে।’’ নাতির নবজন্ম বলে ছুটির আগে ওয়ার্ডে কেক, মিষ্টি, ফুল নিয়ে এসেছিলেন দাদু কেদারনাথ সিংহ। তিনি বলেন, ‘‘নাতির অবস্থা এতই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে ডাক্তারেরা তো বাইরের বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু আর্থিক দুরাবস্থার জন্য আমিই ডাক্তারবাবুদের এখানে ভর্তি রাখতে অনুরোধ করেছিলাম। ওঁদের ঋণ কোনও দিনই শোধ করতে পারব না।’’

শরিতাদেবী বলেন, ‘‘প্রবালের নতুন জন্মদিনে নার্সরা ওকে নতুন পাঞ্জাবি উপহার দিয়েছে। প্রবাল মাটির মূর্তি গড়ে, ভাল ছবিও আঁকে। ওঁকে বলেছি সুস্থ হয়ে নিজের কাজে মন দিতে।’’

হাসপাতাল থেকে হেঁটে বের হওয়ায় আগে প্রবাল বলেন, ‘‘এতগুলো মানুষ যা করলেন, জানি না কী ভাবে ঋণ শোধ করব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Boy Hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE