Advertisement
E-Paper

বালি-রাজ

জলের উপর থেকে ঠাহর করা দায়। বালি মাফিয়াদের উপদ্রবে নদীতে মরণ-ফাঁদ। নামলেই মৃত্যু! লিখছেন অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়ফি বছর বাড়ছে নদীতে স্নানে নেমে অতলে তলিয়ে মৃত্যুও! বালি মাফিয়াদের বালি পাচারের ফলে, নদীতে এই ভয়াল গর্ত তৈরি হচ্ছে। বর্ষাকালে নদী ঘাট সংলগ্ন এলাকায় বালি তোলার ফলে গর্তগুলি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে! আর এমন গর্তে ডুবেই ফি বছর মৃত্যু বাড়ছে বহু মানুষের।

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৬ ০৭:০৯

নদী গর্ভে মরণ কুয়ো!

ফি বছর বাড়ছে নদীতে স্নানে নেমে অতলে তলিয়ে মৃত্যুও!

বালি মাফিয়াদের বালি পাচারের ফলে, নদীতে এই ভয়াল গর্ত তৈরি হচ্ছে। বর্ষাকালে নদী ঘাট সংলগ্ন এলাকায় বালি তোলার ফলে গর্তগুলি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে! আর এমন গর্তে ডুবেই ফি বছর মৃত্যু বাড়ছে বহু মানুষের। গত শনিবার নলহাটি থানার জয়পুরে ব্রাহ্মণী নদীতে স্নান করতে নেমে এমন গর্তে পা হড়কেই মৃত্যু হয়েছে মোনালিসা ঘোষের(১০)। ঘটনার পরে পরেই মৃতার পরিবার ও স্থানীয়দের দাবি, অবৈধ বালি তোলার জন্য নদীগর্ভে তৈরি গর্তে তলিয়েই মোনালিসার মৃত্যু হয়েছে!

স্থানীয়দের দাবি, মোনালিসার যে ঘাটে মৃত্যু হয়েছে, তিন দিন আগেই নদীতে জল আসার জন্য সেই ঘাটেই স্নান করতে নেমে গভীর গর্তে তলিয়ে যান এক মহিলা। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে আরো দু’জন ডুবে যান। কোনও ক্রমে তিন জনকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা। তবে মোনালিসাকে আর বাঁচাতে পারেননি তাঁরা। অভিযোগ যাদের দিকে, সেই বালি মাফিয়ারা অবশ্য নির্বিকার। ব্রাহ্মণী নদীর যত্রতত্র রমরমিয়ে চলছে বালি তোলার কাজ। মোটা বালি, ঝিম বালি, মাঝারি বালি— কত তার রকমফের।

দশ চাকা, ছয় চাকা লরি বালি বোঝাই-সহ কোনওটার দর ৫০০০ টাকা, কোনওটা ৬০০০ টাকা! ট্রাক্টরের ক্ষেত্রে দর পড়ে ৭৫০ টাকা থেকে ১০৫০ টাকা।

রবিবার সকালে সেই বালি-রাজ দেখতেই হাজির হওয়া গেল ব্রাহ্মণী নদী-ঘাটে ঘাটে। নদীঘাট যেন বালি-মাফিয়াদের মেলা-তলা!

কোপ ব্যারাজেও

রামপুরহাট থানার নারায়ণপুর অঞ্চলের বৈধরা গ্রাম সংলগ্ন ব্রাহ্মণী নদীর উপর বৈধরা ব্যারাজ।

ব্যারাজের ওপারে নলহাটি থানার উদয়নগর গ্রাম। ব্যারাজ পেরিয়ে নদীর ধার দিয়ে উদয়নগর থেকে লক্ষীজোল সাড়ে ছয় কিলোমিটার প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার রাস্তা। বছর পাঁচেক আগে তৈরি হওয়া রাস্তা পাথর পিচ উঠে গিয়ে মাটি দেখা যাচ্ছে! রাস্তার এমন হাল কেন? দিনভর এই রাস্তা দিয়েই ট্রাকে পাচার হয়ে যাচ্ছে বালি। সে বালি উঠে আসছে অদূরে নদীগর্ভ থেকে। সারা সারা দিন-রাত!

অদূরে ব্রাহ্মণী নদীতে মাঝ খান দিয়ে জল বইছে। সে দিকে তাকাতেই চমকে উঠতে হয়!

সকাল দশটাতেই বৈধরা ব্যারাজ থেকে ৫০০ মিটার দূরত্বে দেখা গেল প্রায় ১০০টি ট্রাক্টরে বালি বোঝাই করছে। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে বালি ভর্তি পাঁচ ছটি দশ চাকা লরি ও তিন চারটি ট্রাক্টর। স্থানীয় হরিদাসপুর পঞ্চায়েত থেকে লরি ও ট্রাক্টর থেকে টোল আদায় কেন্দ্রে টোল দিয়ে বালি বোঝাই এই গাড়িগুলিই বেরিয়ে যায়। টোল আদায় কেন্দ্র পেরিয়ে যেতেই দেখা গেল, লক্ষ্মী নারায়ণপুর গ্রাম যাওয়ার রাস্তার ধারে জায়গায় জায়গায় চার ফুট তিন ফুট উঁচু করে বালি জমা করা আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বর্ষাকাল বলে এলাকার বালি মাফিয়ারা নদী থেকে বালি তুলে মজুত করে রেখেছে। দাম চড়লে, পরে ওই বালি পাচার হবে।

নিয়ম অনুযায়ী নদী ব্যারাজের দুই কিলোমিটার এলাকায় বালি উত্তোলন করা যায় না। স্থানীয় বাসিন্দারা বললেন, ‘‘কে নিয়ম মানে। কোথায় সেচ দফতরের অফিসার! বহু অভিযোগ করেছি আমরা গ্রাম থেকে। কিন্তু কোনও হেলদোল নেই।’’

জয়পুরে লুঠ

উদয়নগর থেকে লক্ষ্মীজোল সাড়ে ছয় কিলোমিটার। প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার এই পথের উপরই জয়পুর।

গ্রাম থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পাখুড়িয়া থানা এলাকা। গ্রাম ঢোকার প্রায় দুই কিলোমিটার অংশ জুড়ে পাকা সড়ক রাস্তার উপরেই বালি ছড়ানো। বোঝা দায় রাস্তা পিচ পাথর দিয়ে তৈরি না বালি দিয়ে তৈরি! জয়পুর গ্রাম ঢোকার আগে শালবন পেরিয়ে সন্তোষপুর ঘাটে দশ বারোটা ট্রাক্টর বালি বোঝাই করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। বালি ঘাটে যাওয়ার জন্য ধান জমির ছয় ফুট অংশ জুড়ে পাথরের গুঁড়ো বিছানো। নদী পাড়ে বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়েছে খড়ের ছাউনি। সেখানেই অবৈধ বালির কারবারিরা বসেন।

জয়পুর গ্রাম ঢুকতেই গ্রামের মাঝখানে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। সেখানেই বীরবাগান পাড়া ঘাট। ঘাটে আসতে ধান জমির উপর প্রায় ১০০ মিটার দূরত্বের আট ফুট চওড়া রাস্তা।

এই রাস্তা কারা করল?

জানা গেল, বালি মাফিয়ারাই এ রাস্তা তৈরি করেছেন! অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সামনে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত বালির গাড়ির ভিড়। স্থানীয়রা জানালেন, প্রতিবাদ করলেই উলটে বালির কারবারীরা সাবধানে চলতে ফিরতে পরামর্শ দেয়। এ দিন অবশ্য বীরবাগান ঘাটে সেই ভিড় নেই। কেন না, এই ঘাটেই মৃত্যু হয়েছে মোনালিসার। আর তারপরেই এলাকার ক্ষোভ বাড়ছে।

বালিঘাটের উপর অবৈধ ভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে থাকা বাঁশ ও খড়ের ছাউনি দিয়ে তৈরি বালির কারবারীদের অস্থায়ী ঠেকেও লোকজন নেই!

মোনালিসার বোন। নিজস্ব চিত্র।

যন্ত্রেই বালি

জয়পুর ঢোকার আগে একদিকে সন্তোষপুর ঘাট। অন্যদিকে জয়পুরের শেষ সীমান্তে মলমতলা ঘাট।

জয়পুরের ওপারে নলহাটি থানার মাধবপুর গ্রাম। সন্তোষপুর ঘাট থেকে মলমতলা ঘাট এবং ওপাড়ের মাধবপুর ঘাট ব্রাহ্মণী নদী বক্ষে অল্প জলেই চলছে আট দশটি নৌকার উপর যন্ত্র চাপিয়ে বালি উত্তোলন! এলাকার এক বালির কারবারী জানালেন, ‘‘গত এক বছর ধরে এই পদ্ধতিতেই বালি উত্তোলন শুরু হয়েছে।’’ এ দিন সকালেও দেখা গেল অবৈধ ভাবে নদীর দু’পাড়ে নৌকায় যন্ত্র চাপিয়ে নদীর নীচে ৪০ ফুট গভীরতায় পাইপ ফেলে দিয়ে বালি তোলার কাজ চলছে। এই পদ্ধতিতে বালি তুলে নদী ঘাট থেকে প্রায় ৬০ – ৭০ ফুট দূরত্বে ট্রাক্টরে সরাসরি উত্তলন করা বালি লোড করা হচ্ছে।

মাধবপুর ঘাটে জেসিবি লাগিয়ে অবৈধ ভাবে বালি উত্তলন চলছে। মলমতলা ঘাটেও জেসিবি!

এক বালি কারবারী জানালেন, এক ট্রাক্টর বালি ভর্তি করতে লোডিং সমেত ৭৫০ টাকা থেকে ৮৫০ টাকা লাগে। ওভার লোডিং করলে সেটা পড়ে প্রায় ১০৫০ টাকা। যারা লোডিং করেন, তাঁরা জানালেন গাড়ি পিছু দেড়শো টাকা দেওয়া হয়।

নৌকায় মেশিন বসিয়ে বেআইনি ভাবে চলছে বালি তোলা। তার ফলে গভীর গর্ত তৈরি হচ্ছে নদীগর্ভে। নিজস্ব চিত্র।

কোন পথে পাচার

জয়পুর গ্রাম থেকে লক্ষ্মীজোল যাওয়ার রাস্তা। তার আগেই বনদফতরের শাল, মেহগনি গাছের বন। বনাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে গাছ কেটে দশ বারো ফুট উচ্চতায় বালি মজুত করা রয়েছে। এভাবেই বর্ষার সময় নদীতে জল ভর্তি থাকলে বালি উত্তোলন বন্ধ থাকবে তার জন্য বালির কারবারীরা এখানে বালি মজুত করে রাখে। একই ভাবে জয়পুর গ্রামের কামাক্ষা পুকুর পাড়ে জায়গায় জায়গায় বালি মজুত করে রাখতে দেখা গেল।

জয়পুর থেকে বালি অধিকাংশ দশ চাকা ছয় চাকা লরিতে নলহাটি থানার বৈধরা– বাউটিয়া রাস্তা হয়ে কোঠাতলা মোড় পেরিয়ে রেলগেট পেরিয়ে জাতীয় সড়কে যায়। এরপরে মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া জেলার বিভিন্ন প্রান্তে চলে যায় অবৈধ বালি। অভিযোগ, সেচ দফতর থেকে পুলিশ সকলেই জানে। কিন্তু জেনেও কোনও হেলদোল নেই।

জয়পুর গ্রামেই প্রায় ৪০০ টি পরিবারের বাস। এলাকার একাংশের বক্তব্য, গ্রামের যুবকদের কে়উ কেউ ব্যবসায় জড়িয়ে রয়েছে। একজন পারমিট পেলে তার অধীনে ৮০ -৯০ জন ব্যবসা করে। এখন ভোট ঘোষণার পরে থেকেই বালি তোলার পারমিট বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। তবুও এলাকার বেকার যুবকরা ব্যবসা করছে। এতে নদী গর্ভে বাড়ছে ভয়াল গর্তের সংখ্যা।

মৃত মোনালিসা ঘোষের কাকা নারুগোপাল ঘোষ বলেন, ‘‘আমরা আর গ্রাম সংলগ্ন নদী ঘাটে যন্ত্র দিয়ে বালি উত্তোলন করতে দেব না।’’

দফতরের দাবি

সেচ দফতরের ময়ূরাক্ষী নর্থ ক্যানাল শাখার নলহাটি বিভাগের সহকারী বাস্তুকার সুকান্ত দাস বলেন, ‘‘আগেই বলেছি মাঝে মাঝেই অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু অবৈধ কারবার বন্ধ করা যায়নি। সেচ দফতরের বিভিন্ন দফতর আছে তাঁদেরকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে ভাল হয়।’’

সেচ দফতরের ময়ূরাক্ষী নর্থ ক্যানাল বিভাগের রেভিনিউ দফতরের রামপুরহাট বিভাগের আধিকারিক রথীন্দ্রনাথ শীল বলেন, ‘‘গ্রিন বেঞ্চের নির্দেশে পরিবেশ দফতরের ছাড়পত্র না থাকলে আর বালি উত্তোলনের অনুমোদন দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে জয়পুর গ্রামে অবৈধ বালি কারবারীদের রুখতে জেলা পুলিশের সহযোগিতায় খুব শীঘ্রই অভিযান চালানো হবে।’’

জেলা পুলিশের দাবি, শীঘ্রই অভিযান চালানো হবে।

Sand Mafia death traps river
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy