Advertisement
E-Paper

Search for half-baked rice in burns house

বেশ কিছুটা দূর থেকেই পোড়া গন্ধ নাকে আসছিল। গ্রামে ঢোকার মুখে মহারাজনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই স্কুলেই অস্থায়ী ত্রাণ শিবির খুলেছে প্রশাসন।

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৬ ০০:৫৫
শেষ সম্বলটুকু সরিয়ে নেওয়া অন্য জায়গায়। (ডান দিকে) ত্রাণ শিবিরে গুড়-চিঁড়েতে খিদে মেটাচ্ছে আশ্রয় নেওয়া পরিবারের শিশুরা।—নিজস্ব চিত্র

শেষ সম্বলটুকু সরিয়ে নেওয়া অন্য জায়গায়। (ডান দিকে) ত্রাণ শিবিরে গুড়-চিঁড়েতে খিদে মেটাচ্ছে আশ্রয় নেওয়া পরিবারের শিশুরা।—নিজস্ব চিত্র

বেশ কিছুটা দূর থেকেই পোড়া গন্ধ নাকে আসছিল। গ্রামে ঢোকার মুখে মহারাজনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই স্কুলেই অস্থায়ী ত্রাণ শিবির খুলেছে প্রশাসন। বুধবারের বিধ্বংসী আগুনে প্রায় সর্বস্ব খুইয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে গ্রামের প্রায় তিরিশটি পরিবার। বৃহস্পতিবার সকালে শিবিরে এসে পরিস্থিতি দেখে গিয়েছেন প্রশাসনের পদস্থ কর্তারা। মহকুমাশাসক দেবময় চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বুধবার রাত থেকেই পরিবারগুলি শিবিরে রয়েছেন। খাবার আর জামাকাপড়ের বন্দোবস্ত হয়েছে। যত দিন না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, ত্রাণ শিবির খোলা থাকবে।’’

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কথা এখনও চিন্তাই করতে পারছে না সব খোয়ানো পরিবারগুলি। দুপুরে যখন আগুন লাগে, নেভানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন সবাই। আগুন নেভে প্রায় রাত ১০টা নাগাদ। ঠিক কতটা ক্ষতি হয়েছে, রাত পর্যন্ত সেটাই স্পষ্ট ছিল না গ্রামের বাসিন্দাদের বা প্রশাসনের কাছে। এ দিন ভোরের আলো ফোটার পর ত্রাণ শিবির থেকে নিজের নিজের ভিটের দিকে ছুটেছিলেন সবাই।

গিয়ে দেখেছেন, পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে বাড়িঘর। পালাতে না পেরে গোয়ালে বাঁধা গবাদি পশু জীবন্ত পুড়ে গিয়েছে। এ দিন সকালে গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া কাঠের বাক্সে ছাই হয়ে যাওয়া কাগজপত্র হাতড়ে জরুরি নথি খুঁজে চলেছেন এক তরুণ। আধপোড়া ধান অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। কারো মুখে বিশেষ কথা নেই। কান্নার রোলও নেই। থমথম করছে পুরো গ্রাম। গবাদি পশুর দগ্ধ দেহের সামনে মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন এক মহিলা।

পুরুলিয়ার নিতুড়িয়া ব্লকের জনার্দনডি পঞ্চায়েতে মহারাজনগর গ্রাম। বুধবার দুপুর ১টা নাগাদ এই গ্রামের এক প্রান্তে থাকা বিদ্যুতের হাই-টেনশন তারে শর্টসার্কিট হয়ে আগুন লাগে নীচের বাঁশঝাড়ে। ঝোড়ো হাওয়ায় সেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে একের পর এক বাড়িতে। জলের অভাবে আগুনের সঙ্গে যুঝতে পারেননি স্থানীয় বাসিন্দারা। খবর পেয়েই রঘুনাথপুর থেকে গ্রামে এসে পৌঁছয় দমকলের একটি ইঞ্জিন। তাতে কাজ না হওয়ায় পুরুলিয়া থেকে দু’টি আনানো হয়।

রঘুনাথপুরের ডিভিসির নির্মীয়মাণ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সাঁওতালডিহি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আসে আরও দু’টি ইঞ্জিন। পাঁচটি ইঞ্জিনের টানা চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে রাত ১০টা নাগাদ। প্রশাসনের হিসেবে বুধবারের আগুনে প্রায় তিরিশটি বাড়ি পুড়ে গিয়েছে।

বুধবার বাঁশঝাড় থেকে প্রথম আগুনটা লেগেছিল নারায়ণচন্দ্র টুডুর কাঁচা বাড়িতে। এ দিন তাঁর ঘরে গিয়ে দেখা গেল, খড়ের চাল যে দিকে ছিল তার পুরোটাই পুড়ে গিয়েছে। বাড়ির বাইরে বাঁশঝাড়ের সামনে তিনটি ছাগল বাঁধা ছিল। আগুনে ঝলসে মারা গিয়েছে সেগুলিও। মৃত পশুগুলির থেকে কিছুটা দূরে মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন নারায়ণবাবুর এক আত্মীয়া। বললেন, ‘‘বাড়ির চালে দাউদাউ করে জ্বলছিল। সবাই সে দিকেই ব্যাস্ত হয়েছিলাম। ছাগলগুলো যে বাঁধা রয়েছে, সে দিকে কেউ খেয়াল করতে পারিনি। পালাতে না পেরে অবোলা প্রাণীগুলো জ্যান্ত পুড়ে গেল।’’ নারায়ণবাবুর আক্ষেপ, ‘‘কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সর্বস্ব হারালাম।”

ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে যত এগাতে চোখে পড়েছে একের পর এক পুড়ে যাওয়া বাড়ি, বাঁশঝাড়। আগুন নেভাতে রাত পর্যন্ত অনেক জল ঢেলেছে দমকল। রাস্তা কাদায় ভর্তি।

পোড়া বাড়ির দাওয়ায় তিনটে বাক্স খুলে কিছু খুঁজছিলেন বিজয় টুডু। ওই তরুণ বলেন, ‘‘বাক্সে টাকাকড়ি আর বেশ কিছু জরুরি কাগজ ছিল। আগুন লাগতে আগে বাক্সগুলো বের করে আনার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি।’’ বাক্সের মধ্যে কোথাও যদি টাকাকড়ি বেঁচে গিয়ে থাকে, সেই আশায় হাতড়ে যাচ্ছিলেন তরুণটি। একই ভাবে আধপোড়া ধান বাড়ি থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন মোহন টুডু,অর্জুন টুডুরা। বললেন, ‘‘কিছু বোঝার আগেই গ্রামটা জ্বলে উঠল। বাড়ি থেকে কুটোটাও বের করে নেওয়ার সুযোগ পাইনি।’’ মোহনবাবুরা জানান, এই মরসুমে খরায় ভাল চাষ হয়নি। সামান্য যে ধান ছিল আগুনে তার বেশির ভাগই পুড়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বছরভর খাবার জুটবে কোথা থেকে তা ভেবে কুল পাচ্ছে না গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারগুলি।

তবে আপাতত স্কুলের ত্রাণ শিবিরে ঠাঁই মিলেছে তাঁদের। এ দিন সেখানে গিয়ে দেখা গেল, খাবার জন্য গুড় আর চিঁড়ে দিচ্ছেন ব্লক দফতরের কর্মীরা। তার জন্য ভিড় করেছে শিবিরের শিশু কিশোররা। অন্যদিকে, বিলি করা হচ্ছে জামাকাপড়। এক দিকে চলছে রান্নার আয়োজন। শিবিরে আশ্রয় পাওয়ায় মানুষজনেরা জানালেন, প্রশাসন সেই রাত থেকেই খাবার দিচ্ছে। কিন্তু সারা বছরের খাওয়া পরার চিন্তায় তাঁদের আপাতত রাতের ঘুম উড়েছে।

বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসার সময় চোখে মুখে এসে লাগল দমকা গরম হাওয়া। এই হাওয়াই কার্যত ছাড়খার করে দিয়েছে গ্রামটাকে। লু-তে জেরবার হচ্ছেন জেলার বাসিন্দারা। কিন্তু, মহারাজনগরের সব হারানো পরিবারগুলির কাছে হাওয়ার সেই গরম এখন তুচ্ছ।

burns house fire
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy