Advertisement
০৩ মে ২০২৪

পড়তে চেয়ে বারুদের গ্রাম ছাড়ছে আঞ্জুরা

রাত বিরেতে ঘুম ভেঙে যায় বোমা-গুলির শব্দে। পড়তে পড়তেই বইপত্তর গুটিয়ে তখন ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিতে হয় মসজিদের ভিতরে। কতবার যে পড়তে বসেও পড়া হয়নি! নিত্য অশান্তি, বোমাবাজি আর সংঘর্ষের স্মৃতি এখন ওদের তাড়া করে ফেরে সব সময়। সদ্য প্রকাশিত মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল দেখে এ বার তাই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা ভেবেছে ওরা। ওরা, পাড়ুই থানা অঞ্চলের পড়ুয়া— আঞ্জু মানোয়ারা, কুলসুমা, মেহবুব হোসেন।

মহেন্দ্র জেনা
পাড়ুই শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৫ ০২:০৬
Share: Save:

রাত বিরেতে ঘুম ভেঙে যায় বোমা-গুলির শব্দে। পড়তে পড়তেই বইপত্তর গুটিয়ে তখন ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিতে হয় মসজিদের ভিতরে। কতবার যে পড়তে বসেও পড়া হয়নি! নিত্য অশান্তি, বোমাবাজি আর সংঘর্ষের স্মৃতি এখন ওদের তাড়া করে ফেরে সব সময়। সদ্য প্রকাশিত মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল দেখে এ বার তাই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা ভেবেছে ওরা। ওরা, পাড়ুই থানা অঞ্চলের পড়ুয়া— আঞ্জু মানোয়ারা, কুলসুমা, মেহবুব হোসেন।

একেবারে আহামরি কোনও সেরা জায়গা দখল না করলেও, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েও, কুলসুমা-মেহবুবরা সফল। এলাকায় নিত্য সন্ত্রাস এবং আতঙ্কের আবহের জেরে পঠনপাঠন বিঘ্নিত হচ্ছে দেখে, তাদের অভিভাবকেরা অন্যত্র পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেউ কেউ ইতিমধ্যেই গ্রামের বাইরে গিয়ে পঠনপাঠনের জন্য ভর্তিও হয়েছেন। আবার কেউ কেউ মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাইরে যাওয়ার।

‘‘এলাকায় যদি স্বাভাবিক অবস্থা থাকত, মেয়ের নম্বর আরও বেশি হত।’’ আক্ষেপ করে বলছিলেন সাহানা বিবি। পাড়ুই থানার মাখড়া গ্রামের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা সাহানা বিবির মেয়ে আঞ্জু মানোয়ারা খাতুন এবার মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছে। হাঁসড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সদ্য মাধ্যমিক উত্তীর্ণ এই পড়ুয়ার প্রাপ্ত নম্বার ৪৯১। ‘‘আসলে গত বছরের ২৭ অক্টোবরের স্মৃতি ভুলতে পারছি না। খুন, জখম, সন্ত্রাসের সে আতঙ্ক গোটা পরিবার এবং গ্রামের সকলকে তাড়া করে বেড়ায় এখনও।’’

২৭ অক্টোবর আঞ্জুর স্মৃতিতে এখনও দগদগে! সে দিন কত যে গুলি আর বোমা পড়েছিল গাঁ-ঘর-উঠোনে তার ইয়ত্তা নেই! তিন তিনটে লাশ পড়েছিল এলাকায়। ‘‘মনে পড়লেই এখনও চোখের পাতা ফেলতে পারছি না। নিমেষের মধ্যে ওই সব দৃশ্য সিনেমার মত ভেসে উঠছে।’’ সাহানা বিবি মনে করেন, তাঁর মেয়ে আরও ভাল ফল করতে পারত, যদি এলাকার পরিবেশ এবং পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ থাকত। বাড়ির উঠোনে বসে বলছিলেন সাহানা বিবি। ‘‘সবে সকালের কাজ শুরু হয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোখের সামনে পর পর বোমা এসে পড়তে লাগল। প্রাণ বাঁচাতে শাশুড়ি আর দুই মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম পুকুরপাড়ে। চোখের সামনে এলোপাথাড়ি গুলি চলছে, বোমা পড়ছে। বোমার ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল।’’

হাঁসড়া বিদ্যালয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সুবিধা থাকলেও, আঞ্জু মানোয়ারা এখন পাথরচাপড়ি আলআমিন মিশনের ছাত্রী। সে দিনের কথা মনে করতে করতেই চোখে মুখে একরাশ আতঙ্ক। শুধু কি আঞ্জু? একই বিদ্যালয়ের ছাত্রী কুলসুমা খাতুন। মাখড়া লাগোয়া ছাতারবান্দি গ্রামের বাসিন্দা। মাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বর ৪০০। কুলসুমাও ভর্তি হয়েছে জেলার অন্যপ্রান্তে পাথরচাপড়ির আলআমিন মিশনে। কেন ভর্তি হতে হল?

“ছোট বেলা থেকে কত রকমের স্মৃতি, এই হাঁসড়া বিদ্যালয়ে? ছোটবেলার বন্ধু, বান্ধবী, শিক্ষক-শিক্ষিকা। পরিবারের বাবা, মা, আত্মীয়পরিজন। সকলকে ছেড়ে, যেতে তো হচ্ছে।” আঞ্জু মানোয়ারা এবং কুলসুমা বলে চলেন। দু’জনই এখন পাথরচাপড়ি আলআমিন মিশনের ছাত্রী। সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের ওই দুই ছাত্রী জানান, আর্থিক অবস্থা বলতে স্বচ্ছল বলা যাবে না। কিন্তু কোনও মতেই, যত কষ্ট হোক না কেন, তাঁদের পরিবার সিদ্ধান্ত নিয়ে আলআমিন মিশনে ভর্তি করেছেন। জানা গিয়েছে, ভর্তির সময়ে প্রায় মাথা পিছু ১৩ হাজার টাকা লেগেছে। তার পরে, থাকা খাওয়া দাওয়া বাবদ মাসিক দেড় হাজার থেকে দু’হাজার মতো খরচ দিতে হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই দুই পড়ুয়ার সেই অর্থে সামর্থ্য নেই। কিন্তু আতঙ্কের পরিবেশ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে, ছেলেমেয়েদের ‘ভাল মানুষ’ করার তাগিদে সব রকমের কষ্ট মেনে নিয়েছে পরিবার।

কুলসুমার বাবা মহম্মদ মুজিবর রহমান বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মী। মেরে কেটে মাসিক আয় হাজার পাঁচেক টাকা। তার মধ্যে কুলসুমার পঠন পাঠনের ব্যায়ভার বহন করতে হয়। সঙ্গে রয়েছে তাঁর সপ্তম শ্রেণির মেয়ে মমতাজ খাতুন আর পঞ্চম শ্রেণির ছেলে মহম্মদ আরশাদের পঠনপাঠন। বাড়িতে আছেন বৃদ্ধা মা হামিদা বিবি ও স্ত্রী সাহিনা বেগম। কেমন করে সংসারের খরচ চালাবেন?

প্রশ্ন শুনে ঘোর ভাবনায় পড়লেন মহম্মদ মুজিবর রহমান। বললেন, ‘‘এ হেন আতঙ্কের পরিবেশে, নিত্য অশান্তির জেরে ছেলেমেয়ের পড়াশোনা হবে না। তাই ভাল মানুষ করার তাগিদেই তাদেরকে অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছি। মেয়েকে আলামিন মিশনে আর ছেলেকে পাঠিয়েছি ইলামবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে। মেসে থেকে পড়াশোনা করবে। ছোট মেয়েকে বাড়িতেই রেখেছি। বাড়ির লোকেরা বিড়ি বাঁধাইতে হাত লাগিয়েছেন, সংসারে যদি তেল-নুনের খরচ তাও উঠে আসে।’’

আঞ্জুর পরিবারেও প্রায় একই অবস্থা। আঞ্জুর মা সাহানা বিবি বলেন, ‘‘বড় ছেলে সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে স্নাতক স্তরে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছে, ওখানেই থাকছে। ছোট ছেলেকে পাপুড়ি মিশনে দিয়েছি। আর আঞ্জু তো সবে ভর্তি হয়েছে আলআমিন মিশনে।’’

ছোট মেয়েকে নিজের কাছে রেখেছেন সাহানা বিবি। বাড়িতে রয়েছেন বৃদ্ধা শাশুড়ি। কার্যত ফাইনাল পরীক্ষার দিন কয়েক ছাড়া মেয়েদের বাড়িতে রাখার সাহস পাননি তাঁরা। তাই আলআমিন মিশনে সুযোগ পাওয়ার পর, সিদ্ধান্ত নিতে আর দেরি করেননি আঞ্জুর পরিবার। একই পরিস্থিতি ছাতারবান্দির মেহবুব হোসেনের। ইতিমধ্যেই পিচকুরি মিশনে দেওয়ার জন্য প্রাথমিক ভাবে কথাবার্তা পাক্কা করে ফেলেছে তাঁর পরিবার।

মন মানছে না তাঁদের। জানিয়েছেন সে কথা তাঁরা। ‘‘এত ছোট বয়সে, বাড়ি থেকে দূরে সরিয়ে কোথাও রাখার জন্য মন সায় দিচ্ছে না। তবু, এলাকায় নিত্য অশান্তি এবং গণ্ডগোলের কথা মাথায় রেখে, বাড়ির বাইরে রেখে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করার কথা সিদ্ধান্ত হয়েছে আশেপাশের একাধিক গ্রামে।’’ হাঁসড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী আবিদা সুলতানা যেমন। তার প্রাপ্ত নম্বার ৩৮৩। তার পরিবার জানিয়েছে, আরও ভাল ফল হত, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে। তারই মতো, শেখ মুস্তাক, শেখ জুলকর নইম, শেখ জীবন রাও এক পরিস্থিতির শিকার। তাদের অভিভাবক শেখ মুজিব, রহিমা বিবি, শেখ সাত্তাকিন, কোহিনুর বিবিদের প্রশ্ন, ‘‘এ হেন পরিস্থিতির মধ্যে ছেলে মেয়েদেরকে কি ভাবে বাড়িতে রেখে পড়াশোনা করাবো?’’

হাঁসড়া বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অপূর্ব চক্রবর্তীর গলাতেও একই উদ্বেগ! জানালেন, ‘‘বরাবর আমার বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ভাল ফল করেন। তবে এমনটা বলছি না যে তুলনামুলক ভাবে ফল খারাপ হয়েছে। কিন্তু মোটের ওপর বহু মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়াদের নম্বর কমেছে। স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকলে, নম্বর বাড়ানোর সঙ্গে ফল আরও ভাল হত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE