Advertisement
১৮ মে ২০২৪

কে মারল লক্ষ্মীকে, ধন্দ বহাল তদন্তেও

সম্পন্ন মরাঠি পরিবার। তেজারতির ব্যবসাও মন্দ চলছিল না। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে ভরন্ত সংসার। আদ্রার পাঁচুডাঙায় দোতলাবাড়ি। কিন্তু সেই বাড়িতেই নেমে এল অন্ধকার। এক দিন হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেলেন গৃহকর্তা মুন্না ভাটকর।

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৬ ০১:০০
Share: Save:

সম্পন্ন মরাঠি পরিবার। তেজারতির ব্যবসাও মন্দ চলছিল না। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে ভরন্ত সংসার। আদ্রার পাঁচুডাঙায় দোতলাবাড়ি। কিন্তু সেই বাড়িতেই নেমে এল অন্ধকার। এক দিন হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেলেন গৃহকর্তা মুন্না ভাটকর।

স্বামীর ব্যবসা দেখাশোনা শুরু করেছিলেন তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী ভাটকর। ব্যবসার কাজ দেখাশোনা করতে এগিয়ে আসেন তাঁর স্বামীর বন্ধু। কারবার খারাপ চলছিল না। বাজারে লাখখানেক টাকা খাটছিল। ব্যাঙ্কেও লক্ষাধিক টাকা জমা বলে শোনা যায়। স্বামীর নিরুদ্দেশের ধাক্কা কিছুটা সামলে সংসারটা গুছিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। যদিও বড়ছেলে দীপক ও বৌমা বিজেতা শিশুপুত্রকে নিয়ে নীচেরতলায় আলাদা থাকেন। কিন্তু জীবনে যে ফের ধাক্কা আসছে ঠাহর করতে পারেননি। একদিন ভোরবেলায় বাড়ির মধ্যেই খুন হয়ে গেলেন বছর পঞ্চান্নর লক্ষ্মীদেবী। কিন্তু কেন? কারাই বা তাঁকে খুন করলেন? সদুত্তর মেলেনি এখনও।

২০১৪ সালের ১৭ জুলাই। সাতসকালে ফোনটা এসেছিল রঘুনাথপুরের ওসির কাছে। মোবাইলের ওপার থেকে মহিলা কণ্ঠ জানিয়েছিলেন— ডাকাতি হয়েছে তাঁদের বাড়িতে। দুষ্কৃতীরা তাঁর শাশুড়িকে খুন করেছে। বাধা দিতে গিয়ে গুরুতর জখম হয়েছেন তাঁর স্বামী। দাবি করেছিলেন, তিনি নিজে কোনও রকমে পালিয়ে ছাদে গিয়ে পুলিশকে ফোন করছেন।

একসঙ্গে ডাকাতি, খুনের ঘটনার ফোন পেয়ে চমকে উঠেছিলেন ওসি দীপঙ্কর সরকার। তড়িঘড়ি সিনিয়র অফিসারদের খবরটা দিয়েই ছুটেছিলেন আদ্রার পাঁচুডাঙায় ঘটনাস্থলে। গিয়ে দেখেন বাড়ির দোতলায় শোওয়ার ঘর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সেখানেই পড়ে রয়েছে লক্ষ্মীদেবীর নিথর দেহ। অন্য ঘরে রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছিলেন নিহতের বড়ছেলে দীপক। কিছু পরেই সেখানে এসে পৌঁছন রঘুনাথপুরের তৎকালীন এসডিপিও পিনাকী দত্ত, সিআই সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়রা।

পুলিশ কর্তারা জানাচ্ছেন, তদন্তে নেমে তাঁদের চোখে কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়ে। এতবড় ঘটনার পরেও বাড়ির বড়বৌমার গলা ফোনে নিরুত্তাপ বলে মনে হয়েছিল পুলিশ আধিকারিকের। সেটা প্রথম খটকা। লুঠপাট করতে এসে দুষ্কৃতীরা খুন করেছে বলা হলেও, ঘটনাস্থলে কিন্তু পুলিশের চোখে লুঠপাটের কোনও চিহ্ন ধরা পড়েনি। দুষ্কৃতীরা সটান একেবারে দোতলায় উঠে লক্ষ্মীদেবীকেই কেন খুন করল, তারও সঙ্গত কোনও যুক্তি পুলিশ খুঁজে পাচ্ছিল না। ঘটনা ঘিরে এমন বহু প্রশ্ন ভিড় করেছিল তাঁদের মনে।

জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, লক্ষ্মীদেবীর ছোটছেলে বছর ষোলোর বান্টির সঙ্গে কথা বলার পরেই তাঁদের কাছে ধোঁয়াশা কিছুটা কেটে যায়। পুলিশকে বান্টি জানিয়েছিল, দোতলায় মায়ের কাছে সে ও মানসিক প্রতিবন্ধী বোন গুড়িয়া শুয়েছিল। ভোরের দিকে বান্টি জল আনতে নীচে নামে। তখন সে দেখে দাদা দীপক দোতলায় উঠছেন। পুলিশের দাবি, বান্টি তাদের কাছে দাবি করেছিল, উপর থেকে মায়ের চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে দেখে, দাদা মাকে ছুরি দিয়ে কোপ মারছে। দীপক ছুরি নিয়ে তার দিকে তেড়ে গেলে সে কোনওরকমে বোনকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা এঁটে দেয়। তার চিৎকারে পড়শিরা চলে আসায় সে রক্ষা পেয়ে যায়।

পুলিশ জানাচ্ছে, ওই বয়ানের ভিত্তিতে দীপক ও তাঁর স্ত্রীকে আটক করা হয়। দীপকের শরীর ক্ষত ছিল। তাঁকে রঘুনাথপুর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বান্টি দাবি করেছিল, তার টি-শার্টে দাদার রক্তমাখা হাতের ছাপ ছিল। পুলিশ তা ফরেন্সিক তদন্তের জন্য পাঠিয়েছিল। পরে উদ্ধার করা ছুরিটিও পরীক্ষা করতে পাঠানো হয়। তবে সেই রিপোর্ট ঠিকমতো আসেনি বলে পুলিশের একটি সূত্রে জানানো হয়েছে।

দীপক পুলিশের কাছে দাবি করেছিলেন, তেজারতি কারবারের সূত্রে কিছু লোকের সঙ্গে তাঁর মায়ের গোলমাল চলছিল। তারাই ভোরে খুলে রাখা সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে দোতলায় উঠে তাঁর মাকে খুন করে। বাধা দিতে গেলে তিনিও চোট পান। কিন্তু বান্টির বয়ান ও তদন্তের ভিত্তিতে পুলিশ দীপক, তাঁর এক সঙ্গী টিঙ্কু দাস ও বিজেতাকে খুনের ঘটনায় জড়িত অভিযোগে গ্রেফতার করে। পুলিশ দাবি করেছিল, বাড়ি বান্টির নামে রয়েছে। মায়ের কারবারের মালিকও পরে সেই হবে। এ দিকে নিজের কারবারের জন্য দীপক মায়ের কাছে টাকা চেয়েও পাচ্ছিলেন না। তাই তিনি লক্ষ্মীদেবীকে সরিয়ে সমস্ত সম্পত্তি দখল করতে চেয়েছিলেন। এ দিকে, নিজেদের সন্দেহের উর্দ্ধে রাখতে স্ত্রীকে দিয়ে থানায় ফোন করিয়ে তিনি অন্য গল্প ফেঁদেছিলেন। সেই সঙ্গে নিজেই ছুরি দিয়ে হাত কেটে, নিজের গায়ে কোপ মেরে আহত হওয়ার গল্প সাজানোর চেষ্টা করেন।

মাস দুয়েকের মধ্যেই পুলিশ মামলার চার্জশিট জমা দেয়। ফলে তখন জামিন পাননি দীপক ও টিঙ্কু। তবে এক নাবালক ছেলে থাকায় জামিন পেয়ে যান বিজেতা। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তথা অভিযোগকারী বান্টির দেওয়া সাক্ষ্য, খুনের অস্ত্র উদ্ধারের পরেও বিচারক অভিযুক্ত তিনজনকেই বেকসুর খালাস দেন। আইনজীবীদের একাংশ জানাচ্ছেন, পুলিশ অভিযুক্তদের সম্পর্কে খুনের জড়িত থাকার যে কারণ ও নথি তুলে ধরেছিল, আদালতের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি।

অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবী শেখর বসু, আশুতোষ টুডু বলেন, ‘‘দীপকের পিঠের নীচের দিকে আঘাতের চিহ্ন ছিল। ওই জায়গায় কেউ নিজেকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে পারে না। বাইরে থেকে এসেই কেউ হামলা চালিয়েছিল, তা ওই ক্ষত দেখলেই বোঝা যায়। পুলিশ দীপকদের কথায় আমল না দিয়ে আগে থেকেই ধরে নিয়েছিল ওরাই অপরাধী। যা আদালতে পরে টেকেনি। পুলিশ আসলে প্রকৃত তদন্তের দিকেই যায়নি।’’ যদিও পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার দাবি করছেন, ‘‘তদন্ত ঠিক পথেই এগিয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, নিম্নআদালতেই অভিযুক্তেরা শাস্তি পাবে। তা যখন হয়নি, এ বার উচ্চ আদালতে যাওয়া হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Investigation Murder Police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE