নজরবন্দি: সিউড়ির একটি হোটেলে। নিজস্ব চিত্র
আঁধারে সূচ খোঁজার মতো দুষ্কৃতীদের চিনতে লজের পুলিশের একমাত্র ভরসা সিসিটিভির ফুটেজই। যেখানে সন্দেহভাজনদের দেখা মিলেছে। তার ভিত্তিতে শিল্পীকে দিয়ে স্কেচও বানিয়েছে পুলিশ।
যদিও এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সিউড়িতে গয়নার বিপণিতে কয়েক কোটি টাকার ডাকাতির এখনও কোনও কিনারা করতে পারেনি জেলা পুলিশ। কিন্তু যদি লজ থেকে ওই ফুটেজটুকুও না পাওয়া যেত, তখন?
আরও অথৈ জলে পড়তে হতো পুলিশকে। তেমন সম্ভাবনা যথেষ্টই ছিলই। কারণ জেলা সদর ঘুরে দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ হোটেল-লজেই কোনও সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। একই হাল ডাকাতির ঘটনাস্থল, সিউড়ি বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া খান দশেক লজ-হোটেলেরও। ফলে লজে বা হোটেলে ডেরা নিয়ে কোনও দুষ্কৃতী কোনও অপরাধ সংগঠিত করলে, তাঁকে চিহ্নিত করা কার্যত মুশকিল হয়ে পড়বে। কারণ, অস্পষ্ট ভোটার কার্ডের আরও অস্পষ্ট জেরক্স কপি থেকে কি আর কাউকে চিহ্নিত করা সম্ভব? তার উপরে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওই নথিটিও ভুয়োই হয়।
সোমবার গভীর রাতে বাথরুমের দেওয়ালে সিঁধ কেটে রাজ্যের এক বিখ্যাত গয়না প্রস্তুতকারক সংস্থার সিউড়ির বিপণিতে ঢুকে কয়েক কোটি টাকার গয়না সাফ করে দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। তদন্তে পুলিশের দৃঢ় ধারণা, ঠিক পাশের একটি লজে টানা ১৮ দিন ধরে ভাড়ায় থেকে পাঁচ দুষ্কৃতী এত নিঁখুত কায়দায় ওই অপারেশন চালিয়েছে। বিপণির মধ্যে তেমন কোনও ক্লু-ই তারা ছেড়ে যায়নি। সিঁধ কেটে বিপণিতে ঢুকে সিসিটিভি ক্যামেরা খুলে রাখাই নয়, সমস্ত তথ্য প্রমাণ লোপাট করতে বিপণির হার্ডডিস্ক এবং সিপিইউ পর্যন্ত খুলে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে অপরাধীরা। সেই কারণেই পাশের লজের ওই সিসিটিভি ফুটেজ এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ঘটনার তদন্তে।
এখন প্রশ্নটা হল, ওই লজের পরিবর্তে দুষ্কৃতীরা অন্য লজে (যেখানে সিসিটিভি নেই) আশ্রয় নিলে পুলিশ কি এই সূত্রটুকুও পেত? শহরে এমন একটা চুরির পরে সেই প্রশ্নটাই বড় হয়ে উঠেছে। সঙ্গে এমন অভিযোগও রয়েছে, বাসস্ট্যান্ড ঘেঁষা লজগুলির একাংশ বোর্ডারের নথি ঠিকমতো যাচাই না করেই ঘর ভাড়া দিয়ে দেয়। আবার এমন লজও রয়েছে, যেখানে কোনও নথি ছাড়াই ঘণ্টার হিসেবেও ঘর ভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়। মালিকেরা ব্যবসার নামে নিরাপত্তা বিষয়ক সাধারণ নিয়মগুলি মেনে চলেন না, এমন অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। কিন্তু, যাদের এ সবে নজর রাখার কথা, সেই পুলিশ-প্রশাসন তবে কী করে? এক লজ মালিকের কথায়, ‘‘শহরে কোনও বড় ভিআইপি এলে বা কোনও উৎসবের আগে পুলিশ মৌখিক ভাবে সতর্ক করে দেয় বটে। বাকি সময় এ ভাবেই চলে।’’
ব্যতিক্রম অবশ্য রয়েছে। সিউড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রশাসনিক ভবনে যাওয়ার রাস্তার বাঁ দিকে রয়েছে একটি হোটেল। তার মালিক সঞ্জয় অধিকারী বলছেন, ‘‘আমাদের শুধু অনেক সংখ্যায় সিসিটিভি ক্যামেরাই নয়, নাইট ভিশন ও সেন্সর লাগানো ক্যামেরাও রয়েছে। যা দিয়ে একজন বোর্ডারের সন্দেহজনক গতিবিধির উপরে নজরে রাখা সম্ভব। মোবাইলে সেই ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণও করা যায়।’’ প্রায় একই কথা জানান দুবরাজপুর থেকে সিউড়ি বাসস্ট্যান্ডের দিকে আসার অন্য এক হোটেল কর্তৃপক্ষও।
কিন্তু কিছু হোটেল-লজ কেন নিরাপত্তার প্রশ্নে এমন নিষ্ক্রিয়?
ডাকাতির ঘটনা অনেকেরই চোখ খুলে দিয়েছে। মালিকদের একটা বড় অংশ নিজেদের ভুল মেনে নিয়েছেন। ২৪টি ঘরের একটি লজ চালান সিউড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সমিতির সম্পাদক কিসান পাল। কিন্তু কোনও সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। কিসানবাবু বলছেন, ‘‘সবার প্রথম কাজ হল, সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে নেওয়া। খুব শীঘ্রই তা বসাবো।’’ ১৭টি ঘর বিশিষ্ট অপর একটি হোটেলের মালিক রাজদীপ চৌধুরী বলেন, ‘‘আমাদের সিসিটিভি ছিল। খারাপ হয়ে গিয়েছে। সিউড়িতে যে ঘটনা ঘটল, তার পরে আর ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।’’ এ বার সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাবেন বলে দাবি করেছেন অন্যান্যরাও।
গোটা ঘটনায় যাদের দিকে গাফিলতির অভিযোগ উঠছে, সেই পুলিশ এ নিয়ে কোনও কথা বলতে রাজি হয়নি। বারবার যোগাযোগ করা হলেও প্রতিক্রিয়া দেননি জেলার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীরকুমার। নামপ্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্তা কেবল বলেন, ‘‘আমরা এখন ডাকাতির ঘটনার কিনারা নিয়ে ব্যস্ত। দুষ্কৃতীদের ধরার পরে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ করা হবে।’’ তার মধ্যে একই কায়দায় আরও কয়েকটা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে গেলে? আপাতত নিরাপদে নেই জেলা সদর!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy