জগন্নাথ প্রামাণিক। —নিজস্ব চিত্র।
এক জনও নামজাদা প্রাইভেট টিউটর ছিল না। নিজের এবং স্কুলের উপরে ভরসা করেই এগিয়ে গিয়েছিল সে। মহম্মদবাজারের নবগ্রামের এক দরিদ্র পরিবারের সেই ছেলেই এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে পেয়েছে ৯৪ শতাংশ নম্বর!
এর পরে? স্থানীয় বলিহারপুর সম্মেলনী হাইস্কুলের ছাত্র জগন্নাথ প্রামাণিকের নুন আন্তে পান্তা ফুরনো পরিবারের ঘুম ছুটেছে।
মহম্মদবাজারের ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া বলিহারপুর সম্মেলনী হাইস্কুল থেকে দু’ কিলোমিটার দূরেই নবগ্রাম। এই গ্রামেরই বাসিন্দা বলরাম প্রামাণিকের ছেলে জগন্নাথ। পরিবারের আয় বলতে বিঘে চারেক শুখা জমি এবং বাবার হাতে গড়া বছরে একটি দুর্গা, কিছু সরস্বতী প্রতিমা থেকে। বাবার সঙ্গে প্রতিমা গড়ার কাজে হাত লাগায় জগন্নাথ এবং তার দশম শ্রেণিতে পড়া ছোটভাই তারকনাথও। সাংসারিক অভাবের কারণে মাধ্যমিকে তাই ৫২৭ পেয়েও উচ্চ শিক্ষায় পা বাড়ানো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল জগন্নাথের। তার কথায়, ‘‘গ্রামের কাছাকাছি কাপিষ্ঠা হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করার পরে আর্থিক কারণে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম হয়েছিল। বাবা তো এক রকম বলেই দিয়েছিলেন যে, আর পড়াতে পারবেন না। কিন্তু, আমি জেদ ধরে বসে থাকায় শেষমেশ বহু কষ্ট সহ্য করেও বাবা আমাকে বলিহারপুরে ভর্তি একাদশ শ্রেণিতে কলা বিভাগে ভর্তি করে দেন।’’
সেই ছেলেই উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৬৯ পেয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। ইংরেজিতে ৮৮, বাংলায় ৯৬, ভূগোলে ৯৬, সংস্কৃতে ৯১ ও দর্শনে ৯৮ পেলেও ওই ছাত্র মার খেয়ে গিয়েছে ইতিহাসে। পেয়েছে ৫০। ইতিহাসের নম্বর একটু ভাল হলেই জগন্নাথ আরও অনেককেই পিছনে ফেলে দিত বলে মনে করছেন তার স্কুলের শিক্ষকেরা। এ দিকে, সে অর্থে তার কোনও প্রাইভেট টিউটর ছিল না। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক তরুণকুমার প্রামাণিক স্বেচ্ছায় সমস্ত বিষয় দেখাতেন। আর স্কুলের টিফিনের সময় সংস্কৃত শিক্ষক কুমুদরঞ্জন দাস, ইংরেজি শিক্ষক মাসুদ হোসেন-সহ স্কুলের অন্য শিক্ষকেরাও ওই ছাত্রকে সাহায্য করে গিয়েছেন। জগন্নাথ নিজে বলছে, ‘‘স্কুলের সহপাঠী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী— ওঁদের কোনও দিনই ভুলব না। ওঁরা যে ভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’’ কিন্তু, এখন জগন্নাথের ভবিষ্যত কী, কী ভাবেই বা সে কলেজে ভর্তি হবে, উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না পরিবার। ঘুম ছুটেছে জগন্নাথেরও।
দুশ্চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছে তার বাবা বলরাম প্রামাণিক এবং মা হীরাদেবীকে। মা বলছেন, ‘‘আমরা চাই আমাদের দুই ছেলেই পড়াশোনা করুক। মানুষের মতো মানুষ হোক। কিন্তু, পড়ানোর সাধ্য তো নেই। তাই কী করব, ভেবে পাচ্ছি না। যদি কেউ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, তা হলে চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।’’ এ দিকে, জগন্নাথের বাবা জানাচ্ছেন, দুই ছেলেই পড়াশোনায় ভাল। এমন ছেলেদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাক, কোন মা-বাবা চাইবে! ‘‘আমাদের মতো যাঁরা হতভাগ্য, তাঁরা ছাড়া আর কেউ চান না যে এমন ছেলেদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাক। এমন ভাগ্য যেন কারও না হয়,’’— আক্ষেপ বাবার। অথচ যাঁরা একটু ভাল ফল করেছে, তাঁরা বাড়িতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে কত আনন্দ করছে। মা-বাবারা গর্ব করছেন। অথচ তাঁর ছেলেরা কী ভাবে পড়বে, সেই দুশ্চিন্তাতেই ভেঙে পড়েছেন বলরামবাবু।
জগন্নাথের স্কুলের প্রধান শিক্ষক মৈনাক দে এবং সহকারি প্রধান শিক্ষক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়-সহ শিক্ষকদের অনেকেরই অবশ্য আশ্বাস, ‘‘আমরা ওকে যথাসাধ্য সহযোগিতার চেষ্টা করব। পাশাপাশি কোনও প্রতিষ্ঠান বা সহৃদয় ব্যক্তি জগন্নাথদের মতো দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়ান, তা হলে স্কুলের পক্ষ থেকেও কৃতজ্ঞ থাকব।’’
অন্য দিকে, জগন্নাথ-সহ ব্লকের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে দুঃস্থ মেধাবী ছেলেমেয়েদের সরকারি ভাবে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন মহম্মদবাজারের বিডিও সুমন বিশ্বাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy