Advertisement
E-Paper

অঙ্ক সহায়, জোটের অঙ্কেও চিন্তায় তৃণমূল

দিনভর একাধিক কর্মিসভা সেরে বাঁকুড়া শহরের ফার্স্ট ফিডার রোডের বাড়িতে দুপুরে একটু জিরিয়ে নেওয়ার ফাঁকে এই প্রশ্নটা শুনে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতেই হাত নাড়ালেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট! ও-সব নিয়ে মাথাই ঘামাচ্ছেন না। মিনতি মিশ্র বলেও দিলেন, ‘‘আমি-ই জিতছি! এটা নিশ্চিত।’’

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৬ ০১:৪৬
বসে থাকার সময় নেই। প্রার্থী ঘোষণার পরের দিন বুধবারই প্রচারে শম্পা দরিপা। আগেই পথে নেমেছেন মিনতি মিশ্র। স্টেথোস্কোপ ছেড়ে তুলি হাতে সুভাষ সরকারও।—অভিজিৎ সিংহ

বসে থাকার সময় নেই। প্রার্থী ঘোষণার পরের দিন বুধবারই প্রচারে শম্পা দরিপা। আগেই পথে নেমেছেন মিনতি মিশ্র। স্টেথোস্কোপ ছেড়ে তুলি হাতে সুভাষ সরকারও।—অভিজিৎ সিংহ

লড়াইটা কি এ বার একটু ‘টাফ’?

দিনভর একাধিক কর্মিসভা সেরে বাঁকুড়া শহরের ফার্স্ট ফিডার রোডের বাড়িতে দুপুরে একটু জিরিয়ে নেওয়ার ফাঁকে এই প্রশ্নটা শুনে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতেই হাত নাড়ালেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট! ও-সব নিয়ে মাথাই ঘামাচ্ছেন না। মিনতি মিশ্র বলেও দিলেন, ‘‘আমি-ই জিতছি! এটা নিশ্চিত।’’

বাঁকুড়া কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী (বিদায়ী বিধায়কও) নিজের জয় নিয়ে নিশ্চিত। কিন্তু, তাঁর প্রচারের কাজে ঘোরা দলের কর্মীদের সবাইকে এতটা নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে না কেন? যেখানে সবচেয়ে আগে প্রার্থী ঘোষণা করেছে তৃণমূল। শহরের অধিকাংশ দেওয়াল তাদেরই দখলে। প্রচারেও কর্মীরা নেমেছেন বিপক্ষের ঢের আগে। তার পরেও মিনতিদেবীর বাড়ির বাইরে ছায়ায় বসে থাকা কর্মীরা জানালেন, নিশ্চিন্ত থাকার জো নেই। একে তাঁদের প্রার্থীর বিপক্ষে যে দু’জন লড়ছেন, তাঁরা দু’জনেই ‘হেভিওয়েট’। তার উপর, বাম-কংগ্রেস এ বার মিলে গিয়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, গত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে তৃণমূলের ভোট-প্রাপ্তির গ্রাফ অল্প হলেও নিম্নমুখী হয়েছে। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস-তৃণমূলের জোট ছিল। জোট প্রার্থী, মিনতিদেবীর স্বামী কাশীনাথ মিশ্র পেয়েছিলেন ৯২ হাজার ৮৩৫ ভোট। পরের বছর কাশীনাথবাবুর মৃত্যুতে মিনতিদেবীকে উপনির্বাচনে প্রার্থী করে তৃণমূল। মিনতিদেবী জিতলেও ভোট কমে শাসকদলের। আবার ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের ফল অনুযায়ী, বাঁকুড়া বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের ভোট প্রাপ্তি ছিল ৭২ হাজার ৯৪২। অর্থাৎ, ২০১১ সালের তুলনায় প্রায় ২০ হাজার কম।

ওই লোকসভা ভোটে যাবতীয় হিসেব নিকেশ উল্টে দিয়েছিল বিজেপি। ২০১১ সালে বাঁকুড়ায় যে দলের ভোট ছিল মাত্র ৫ হাজার ৭৩২, সেখানে তিন বছর পরে প্রবল মোদী-হাওয়ায় এই কেন্দ্রে প্রায় দশ গুণ ভোট বাড়িয়ে বিজেপি-র ঝুলিতে যায় ৫১ হাজার ১৭২ ভোট! তৃণমূল-সিপিএম-কংগ্রেস, তিন দলেরই ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসিয়েছিল বিজেপি। ২০১১ সালে বামফ্রন্ট এই কেন্দ্রে ৬৩ হাজার ৭৪৫ ভোট পেয়েছিল। লোকসভায় তা এক ধাক্কায় কমে হয় ৪৬ হাজার ১৬৬। একক লড়াই করে বাঁকুড়া বিধানসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস পেয়েছিল স্রেফ ৩,০১২টি ভোট। কংগ্রেস প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।

নিছক পাটিগণিতের হিসাবে তাই এ বারের ভোটে তৃণমূলের চিন্তার কোনও কারণ নেই। কারণ, লোকসভা ভোটের পরে রাতারাতি যে বিজেপি তাদের মূল প্রতিপক্ষ হিসাবে উঠে এসেছিল, এখন তাদের দাপট অনেকটাই স্তিমিত। বামেদের সংগঠনও বাঁকুড়ায় সে ভাবে শক্তিবৃদ্ধি করতে পারেনি। তবু, কেন বুকে হাত রেখে ‘জিতছি-ই’ বলতে পারছেন না তৃণমূল কর্মীরা? তাঁদের মতে, জোট প্রার্থী শম্পা দরিপা এবং বিজেপি-র রাজ্য নেতা সুভাষ সরকার, দু’জনেই প্রতিপক্ষ হিসাবে কঠিন ঠাঁই।

দলবিরোধী কাজের অভিযোগে তৃণমূল থেকে সদ্য বহিষ্কৃত শম্পাদেবী যোগ দিয়েছেন কংগ্রেসে। এবং তার পরেই বাম-কংগ্রেস জোটের তরফে এখানে প্রার্থী করা হয়েছে তাঁকে। সেই ২০০০ সাল থেকে তিনি তৃণমূলে। দীর্ঘদিন ধরে মহিলা তৃণমূলের জেলা সভানেত্রীর পদ সামলেছেন। বাঁকুড়া পুরসভার চেয়ারম্যানও ছিলেন। এই অবস্থায় তৃণমূলের অন্দরে আশঙ্কা, বাম ও কংগ্রেসের মিলিত ভোট তো তিনি পাবেনই। তার সঙ্গে তৃণমূলের ভোটও কাটবেন! বেশ কিছু তৃণমূল কর্মীর কথায়, ‘‘গতবার তো আমাদের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট ছিল। এ বার ওরা সিপিএমের সঙ্গে। পরিস্থিতি পুরো আলাদা। ফলে, ঠিক কী হবে, কেউই আগাম আঁচ করতে পারছে না।’’

সিপিএমের বাঁকুড়া জোনাল কমিটির সম্পাদক প্রতীপ মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, “লড়াইটা এ বার পাঁচ বছরের বিধায়কের সঙ্গে পাঁচ বছরের চেয়ারম্যানের। কে কাজের লোক, তার উত্তর মানুষ জানেন। মিনতিদেবী আমার শ্রদ্ধেয়া। কিন্তু, যে সব লোকজনের সঙ্গে তিনি ওঠাবসা করেন, তাঁদের ভাবমূর্তি ভাল নয়।’’ আর শম্পাদেবীর বক্তব্য, “পাঁচ বছর সময় পেয়েই বাঁকুড়া শহরটাকে ঢেলে সাজিয়েছিলাম। আরও অনেক কিছুই করার ছিল। কিন্তু, তৃণমূল উন্নয়ন চায় না। এ বার মানুষের আস্থা পেলে গোটা বিধানসভার প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতেও কাজের সুযোগ পাব।’’

শহরের অনেক তৃণমূল কর্মীও এ কথা অস্বীকার করতে পারছেন না। তাঁরা মতে, বাঁকুড়া কেন্দ্রে জেতা-হারা তো ঠিক করে দেয় বাঁকুড়া শহরই! আর কে না জানে, শহরে শম্পাদেবীর নিজস্ব ভোট ব্যাঙ্ক রয়েছে। ঘটনাও হল, গত বছর বাঁকুড়া পুরভোটে জিতলেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি তারা। ২৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১২টি পায় তারা। তিন নির্দলের সমর্থন নিয়ে পুরবোর্ড গড়তে হয়েছিল। বরং বামেদের ভোট বাড়ে। তারা ৬টি ওয়ার্ডে জেতে।

আবার বিজেপি-কেও পুরোপুরি উড়িয়ে গিতে পারছে না তৃণমূল। সে যতই এ বার ভোটে বিজেপি-র হাওয়া কমুক না কেন। অনেকেরই মতে, বিজেপি প্রার্থী, সুভাষ সরকারের একটা নিজস্ব ভোট ব্যাঙ্ক আছে। পেশায় চিকিৎসক সুভাষবাবুর সঙ্গে হাজার হাজার মানুষের ব্যক্তিগত সংযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গেই গত কয়েক বছরে বাঁকুড়া শহর ও শহর সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামেও কিছুটা সংগঠন বাড়িয়ে নিতে পেরেছে বিজেপি।

সুভাষবাবুর অভিযোগ, বাঁকুড়ার সামাজিক যে সব সমস্যা রয়েছে, তা নিয়ে মিনতিদেবী মাথা ঘামাননি। এই বিধানসভা কেন্দ্রের প্রত্যন্ত ব্লক বা অঞ্চলের স্বাস্থ্যকেন্দ্র গুলির হাল খুব খারাপ। জল প্রকল্পের কাজের গতি থমকে গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিধানসভায় যে ভাবে সওয়াল করা উচিত ছিল, তিনি তা করেননি। তাঁর আরও বক্তব্য, “বয়সের ভারে মিনতিদেবীর কাজের সক্রিয়তা কমেছে। আর সেই সুযোগে তাঁর ঘনিষ্ঠ কিছু সুযোগসন্ধানী লোক মানুষকে ঠকিয়ে মুনাফা লুটেছে। এ সব আর মানুষ মেনে নেবেন না।’’ বিজেপির হাওয়া স্তিমিত হয়ে গিয়েছে বলেও মানতে নারাজ

মিনতিদেবী নিজে অবশ্য এই সবকে পাত্তাই দিতে রাজি নন। তাঁর কথায়, “বিরোধী দুই প্রার্থীরই কোনও গুরুত্ব নেই আমার কাছে। গত কয়েকটা নির্বাচনে দলের কী ফলাফল হয়েছে, তা নিয়েও আমি ভাবতে নারাজ। আমি জিতবই।’’ কাজ না করার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এই বিধানসভা কেন্দ্রে ঢালাও উন্নয়নের কাজ হয়েছে। সেই কাজে আমিও অন্যতম শরিক।’’ বয়সও কোনও বিষয় নয় জানিয়ে বিদায়ী বিধায়ক বলে দিচ্ছেন, ‘‘এখনও দিনে পাঁচ বার সিঁড়ি ভেঙে ওঠানামা করি!’’

এই সিঁড়ি-ভাঙা অঙ্কেই কিন্তু দাঁড়িয়ে রয়েছে বাঁকুড়ার ভোট।

Trinamool Congress Assembly Election 2016
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy