ধোঁয়ায় নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয় কারখানার সংলগ্ন এলাকার মানুষজনের। ছবি: সুজিত মাহাতো
সারাক্ষণ বিছানার উপরে মশারি খাটিয়ে রাখেন বিভীষণ কুমার। মশারির ছাদে আবার একটা চাদর বিছানো। না হলে রক্ষে নেই। বাড়ির পাশেই স্পঞ্জ আয়রন কারখানা। অভিযোগ, সেখান থেকে উড়ে আসা ধোঁয়া থেকে ঝরে পড়া কালো গুঁড়োর চোটে এক বেলাতেই ধোপদুরস্ত চাদর হয়ে যাবে কুচকুচে। বলরামপুরের দাঁতিয়া গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশের ক্ষোভ, দূষণের জেরে তাঁদের জীবন এমনই ভাবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
জামশেদপুর যাওয়ার ৩২ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে বলরামপুর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার ছাড়িয়ে দাঁতিয়ার শুরু। একেবারে ঝাড়খণ্ডের সীমানায় গ্রাম। কয়েকটা ঘর পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডের চৌহদ্দিতে পড়ে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালে ওই এলাকায় স্পঞ্জ আয়রন কারখানা গড়ে ওঠা শুরু হয়। ২০০৪ থেকে শুরু উৎপাদন।
দাঁতিয়া, বহড়াডি, ডাহারডি, ধাদকিডি, ভালুবাসা-সহ কারখানা এলাকার কিছু গ্রামের বাসিন্দাদের অনেকে দাবি করেছেন, মাস পেরোতেই তাঁরা দূষণের ব্যাপারটা টের পেতে শুরু করেছিলেন। এখন সেখানে চারটি কারখানা। গ্রামবাসীর একাংশের অভিযোগ, ব্যস্ত সময়ে দূষণ কমানোর যন্ত্র কিছুক্ষণ চালিয়েই কাজ সারা হয় কোথাও কোথাও। বাকি দিন-রাত বাতাস বিষিয়ে চলে কারখানার ধুলো-ধোঁয়া। এলাকায় গিয়ে দেখা গিয়েছে, পুকুরের জলে কালো সর পড়েছে। খেতের পালং শাকও কালচে।
সোলার প্যানেলে কালো স্তর।
দাঁতিয়ার জগন্নাথ পরামানিক ঝুমুর গান বেঁধেছেন তাঁদের গ্রামের সমস্যার কথা নিয়ে। তাতে বলেছেন, যখন ফ্যাক্টরিগুলি গড়ে উঠেছিল, আশা করেছিলেন ঘরে ঘরে কাজ আসবে। কিন্তু এখন, ‘‘কাজের কথায় মারো গুলি। কালো হল গাছগাছালি।’’ নতুন বছরের গোড়ায় ‘ভালুবাসা আদিবাসী মূলবাসী অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করেছেন ওই সমস্ত গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশ। অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক সীতারাম হাঁসদা বলেন, ‘‘ব্লক প্রশাসনের কাছে একপ্রস্ত অভিযোগ জানানো হয়েছে। এ বার রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কাছে যাওয়া হবে।’’
আজকাল আর চাষও ভাল হচ্ছে না বলে দাবি মধুসূদন কুমার, পদ্মলোচন পরামানিকদের। ছুকনি কুমার জানান, ভাত রেখে একটু উঠে গেলে ফিরে দেখেন উপরে কালো গুঁড়ো ছড়িয়ে। সেটাই খেতে হয়। ঝাড়খণ্ডের দিকটিতে বাড়ি রমানাথ কুমারের। তিনি বলছিলেন, ‘‘একটা সোলার পাম্প আছে। রোজ সকালে পুরু হয়ে ছাই পড়ে থাকে। আট-দশ বালতি জল ঢেলে প্যানেল ধুলে পাম্প চালু হয়।’’
সঙ্কটে পরিবেশ • স্পঞ্জ আয়রন কারখানা থেকে আসা কালো গুঁড়োয় অনেক রকমের কণা থাকে। তার মধ্যে সবথেকে বেশি ক্ষতি করে সালফার, কার্বন আর সিলিকার কণা। • এই ধরনের দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার ফলে ফুসফুসের সঙ্কোচন-প্রসারণের ক্ষমতা কমে যায়। দেখা দেয় নিউমোকোনিয়োসিস নামে এক ধরনের রোগ হওয়ার আশঙ্কা। • দূষিত গুঁড়ো গিয়ে পড়ে জলের মধ্যে। জলের প্রাণী এবং গাছপালার ক্ষতি হয়। নষ্ট হয় বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য। • গাছের পাতায় দূষিত স্তর জমে ক্ষতি হয় ফসলের। কৃষিনির্ভর মানুষজনের জীবিকা সঙ্কটে পড়ে। • চোখে সংক্রমণ হতে পারে দূষিত গুঁড়ো থেকে। হতে পারে চামড়ার রোগ।
কারখানাগুলিতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের নাগাল পাওয়া যায়নি। শুধু একটি কারখানার ম্যানেজার অমিত কুমার দাবি করেন, তাঁরা দূষণ নিয়ন্ত্রণের ‘ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক প্রেসিপিটেটর’ যন্ত্র নিয়মিত চালান। তার পরেও আশপাশের গ্রামে এই অবস্থা হয় কী করে? তাঁর জবাব, ‘‘বলতে পারব না।’’
জয়েন্ট বিডিও (বলরামপুর) নারায়ণচন্দ্র মণ্ডল জানান, গ্রাম থেকে অভিযোগ পেয়ে তাঁরা ব্লকের এক আধিকারিককে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি ওই এলাকায় গিয়ে রিপোর্ট তৈরি করছেন। পুরুলিয়ার জেলাশাসক অলকেশপ্রসাদ রায় বলেন, ‘‘ব্যাপারটা প্রশাসনের নজরে রয়েছে। পদক্ষেপ করা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy