Advertisement
০১ মে ২০২৪

ইট-বালির দোসর ধান-গম, বিপজ্জনক গ্রামের রাস্তাও

বছর কয়েক আগেও গ্রামের রাস্তার উপর দিয়ে যাওয়া রাস্তাতেই সীমাবদ্ধ ছিল বিপদের আশঙ্কা। এখন তা বাসিন্দাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। গ্রামবাসীদেরই একাংশ নিজেদের সামান্য সুবিধার জন্য ওই বিপদ ডেকে আনছে বলে অভিযোগ। প্রশাসন এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শহরের রাস্তাগুলিতে মূলত দখলদারি চলে ইমারতি সামগ্রীর।

অর্ঘ্য ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৫ ০০:৩৯
Share: Save:

বছর কয়েক আগেও গ্রামের রাস্তার উপর দিয়ে যাওয়া রাস্তাতেই সীমাবদ্ধ ছিল বিপদের আশঙ্কা। এখন তা বাসিন্দাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। গ্রামবাসীদেরই একাংশ নিজেদের সামান্য সুবিধার জন্য ওই বিপদ ডেকে আনছে বলে অভিযোগ।

প্রশাসন এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শহরের রাস্তাগুলিতে মূলত দখলদারি চলে ইমারতি সামগ্রীর। জেলার গ্রামাঞ্চলের রাস্তায় ইমারতি সামগ্রীর পাশাপাশি বছরভর দখলদারি চলে নানা কৃষিজাত ফসলের। ধান, গম, সরিষা, তিল-সহ নানা ফসলের ঝাড়াই বাছাই চলে রাস্তার উপর। আর ফসল বিছানো সেই রাস্তার উপর দিয়ে প্রাণের ঝুঁকি যাতায়াত করতে হয় পথচারীদের। হামেশায় দুর্ঘটনার কবলেও পড়তে হয় তাঁদের। কিন্তু কারও কোনও হেলদোল নেই বলে অভিযোগ।

এতদিন গ্রামাঞ্চলের উপর দিয়ে যাওয়া রাস্তাতেই ওই বিপদ সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তা ঢুকে পড়েছে পাড়ায় পাড়ায়। কারণ গত কয়েক বছর ধরে কেন্দ্রীয় ত্রয়োদশ অর্থ কমিশন, রাজ্য তৃতীয় অর্থ কমিশন, ১০০ দিন কাজের প্রকল্প, ব্যাকওয়ার্ড রিজিওন গ্র্যান্ট, গ্রাম পঞ্চায়েত স্বশক্তিকরণ যোজনা-সহ বিভিন্ন প্রকল্পে পাড়ায় পাড়ায় তৈরি হয়েছে কংক্রিটের রাস্তা। ওইসব রাস্তাই এখন কার্যত মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। কারণ রাস্তাগুলি বিভিন্ন ফসল ঝারাই বাছাই থেকে সিদ্ধ ধান শুকানোর জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু মাত্র প্রান্তিক চাষিরাই নন, স্কুল শিক্ষক থেকে শুরু করে সমাজের তথাকথিত সচেতন মানুষজনও একই কাজে রাস্তা ব্যবহার করছেন। আর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পথচারীদের।

ময়ূরেশ্বরের গিধিলা গ্রামের গোপীনাথ বায়েন লোকপাড়া হাই স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। ৪ কিমি দূরের স্কুলে যেতে পোলিও আক্রান্ত গোপিনাথের ভরসা হাত রিকশা। বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা ঢালাই রাস্তার পর সে পিচ রাস্তার নাগাল পায়। কিন্তু ওই রাস্তাটুকু পেরোতেই তার ঘাম ছুটে যায়। সে জানায়, ‘‘এতদিন পীচ রাস্তায় ফসল ঝাড়াই বাছাই হত। এখন পাড়ার ঢালাই রাস্তাতেও তা হচ্ছে। আর ধানের কুটো ভর্তি রাস্তায় প্যাডেল করতে হাতে ব্যাথ্যা হয়ে যায়।’’ নানা কাজের জন্য গ্রামে গ্রামে ঘোরেন মল্লারপুরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার সাধন সিংহ। তিনি বলেন, ‘‘প্রায় প্রতিটি গ্রামের ঢালাই রাস্তায় সারা বছর ফসল ঝাড়াই বাছাই ও পাশাপাশি শুকানোর কাজও চলে। তার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় মোটর বাইক হড়কে উল্টে ক্ষত বিক্ষত হতে হয়।’’

লাভপুরের ধনডাঙার বিবেকানন্দ মণ্ডল, কীর্ণাহারের অজয় রায়রা জানান, সব থেকে সমস্যা হয় পল মাড়াইয়ের সময়। বাড়িতে ধান কিংবা গম ঝড়ানোর পর কুটো দিনের পর দিন রাস্তায় ফেলে রাখা হয়। পথচারী এবং যানবাহন চলাচলের পর কুটো থেকে শস্য ঝরে পড়ে। তখন রাস্তার উপরেই কুলো কিম্বা ফ্যানের বাতাস দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। এতে ধুলো উড়ে লাগে পথচারীর চোখে মুখে। গা জ্বালা করার পাশাপাশি ওই ধুলোগুড়ো চোখে লাগায় হামেশায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটে।

একইকথা বলছিলেন ময়ূরেশ্বরের ডাঙাপাড়ার নিতাই কোনাই, আমোদপুরের নোটন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়রা। তাঁরা জানান, শুধুমাত্র চাষিরাই নন, সমাজের সচেতন মানুষ হিসাবে চিহ্নিতরাও নিজেদের সামান্য সুবিধার জন্য অন্যদের বিপদের মুখে ঠেলে দেন। অথচ কারও কোনও হেলদোল নেই। ময়ূরেশ্বরের ঢেকা পঞ্চায়েতের প্রধান মিঠু গড়াই, নানুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি চিন্তা মাঝিরা বলেন, ‘‘এলাকার মানুষের চলাচলের সুবিধার জন্যই গ্রামে গ্রামে ঢালাই রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু আমরাও দেখেছি ঢালাই রাস্তায় ফসল ঝাড়াই বাছাই হচ্ছে। প্রশাসনিক ভাবে ওই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তবু যদি লিখিত ভাবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাই তাহলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।’’

কেন এই দখলদারির প্রবণতা?

বিজেপি জেলা আহ্বায়ক অর্জুন সাহা বলেন, ‘‘জমি মালিকের বাড়িতে ঝাড়াই বাছাইয়ের সুযোগ হারিয়ে মুলত বর্গাদার ভাগীদাররা রাস্তাকে বেছে নিয়েছেন।’’ ময়ূরেশ্বরের কলেশ্বর গ্রামের শক্তিপদ ভল্লা, লাভপুরের মস্তলীর সুনীল মণ্ডলরা আবার দায়ি করেছেন যন্ত্র সভ্যতার দাপটকে। তাঁদের মতে, এক সময় প্রতিটি বাড়িতে একাধিক গরু মোষ পোষা হত চাষের জন্য। ধান, গম-সহ বিভিন্ন ফসল ঝরানোর পর কুটোয় থাকা শেষাংশ ঝরানোর জন্য তার উপর ওইসব গবাদি পশুকে পাকে পাকে ঘোরানো হত। এখন ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলারের দাপটে অধিকাংশ গৃহস্থের গোয়াল থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে গবাদি পশু। আর যানবাহনের চাকায় খড়কুটো মাড়ানোর জন্য দিনের পর দিন ফেলে রাখা হচ্ছে রাস্তায়।

বিজেপি-র কৃষক সংগঠনের জেলা সভাপতি ব্রজগোপাল মণ্ডল, কংগ্রেসের কৃষক সংগঠনের জেলা সভাপতি সৈয়দ কাসাফদ্দোজা কিম্বা সিপিএমের কৃষক সভার জেলা সম্পাদক আনন্দ ভট্টাচার্য্যরা প্রায় একই সুরে জানিয়েছেন, সচেতনতা বোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি যৌথ খামারের আদলে গ্রামে গ্রামে বিনা খরচে ফসল ঝাড়াই বাছাইয়ের আধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত ফসল ঝাড়াইকেন্দ্র গড়া হলে কিছুটা হলেও রাস্তার উপদ্রপ কমতে পারে। গবাদি পশুপালনে সরকারি সহযোগিতাও সহায়ক হতে পারে বলে তাঁদের অভিমত।

জেলার মন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গ্রাম স্তরে কোনও ফসল ঝাড়াই কেন্দ্র আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে লিখিত আকারে কোনও পক্ষ থেকে প্রস্তাব পেলে তা বিধানসভায় তুলতে পারি। পশুপালনে উৎসাহ দিতে ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকার নানা প্রকল্প নিয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Argha Ghosh village BJP accident
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE