Advertisement
০৪ মে ২০২৪

জল এল কি, কান পেতে বাসিন্দারা

কলের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও লোকে কান খাড়া করে থাকে। যদি কলের মুখ থেকে শোঁ... শব্দটা শোনা যায়। তার মানে এখনই জল আসবে। শব্দটা কানে এলেই যে যেখানে থাকে পড়িমড়ি করে দৌড়ে বাড়ি থেকে বালতি, জারিকেন এনে কলের মুখের সামনে পেতে ধরেন। দেরি করার উপায় নেই। দেখতে দেখতে নিমেষের মধ্যে কলের সামনে বালতি, গামলা, জারিকেন, বোতল, ঘড়ার লম্বা লাইন পড়ে যায়। এটাই পুঞ্চা বাজার এলাকার বাসিন্দাদের রোজনামচা।

জলের জন্য লম্বা লাইন। এটাই নিত্যদিনের ছবি। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।

জলের জন্য লম্বা লাইন। এটাই নিত্যদিনের ছবি। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।

সমীর দত্ত
পুঞ্চা শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৫ ০১:৩৬
Share: Save:

কলের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও লোকে কান খাড়া করে থাকে। যদি কলের মুখ থেকে শোঁ... শব্দটা শোনা যায়। তার মানে এখনই জল আসবে। শব্দটা কানে এলেই যে যেখানে থাকে পড়িমড়ি করে দৌড়ে বাড়ি থেকে বালতি, জারিকেন এনে কলের মুখের সামনে পেতে ধরেন। দেরি করার উপায় নেই। দেখতে দেখতে নিমেষের মধ্যে কলের সামনে বালতি, গামলা, জারিকেন, বোতল, ঘড়ার লম্বা লাইন পড়ে যায়। এটাই পুঞ্চা বাজার এলাকার বাসিন্দাদের রোজনামচা।

এখানকার বাজার এলাকা দু’টি ভাগে বিভক্ত পুঞ্চা ও ডাঙা। পুঞ্চার বাসিন্দারা জল পান সকালে আর বেলার দিকে ডাঙার বাসিন্দারা জল পান। বিকেলেও আগে পুঞ্চা, পরে ডাঙায় জল দেওয়া হয়। বাসিন্দারা জানান, জল কতক্ষণ দেওয়া হবে, তারও নির্দিষ্ট কোনও সময় নেই। কখনও এক ঘণ্টা কখনও বা আধ ঘণ্টা কি তারও কম। তার মধ্যে বিদ্যুত্‌ চলে গেলে জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। তখন তীর্থের কাকের মতো কখন বিদ্যুত্‌ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে, সে অপেক্ষায় বাসিন্দাদের থাকতে হয়। ফলে কলে জল পাওয়া এখানকার বাসিন্দাদের কাছে লটারি পাওয়ার মতোই। ডাঙার চা-তেলেভাজা বিক্রেতা বামদেব বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে এলাকার বধূ লতিকা বাউরি, অঞ্জলি বাউরিদের ক্ষোভ, “জল নিয়ে সত্যিই আমরা খুব সমস্যার মধ্যে থাকি। সকালের দিকেই জলের বেশি প্রয়োজন। কিন্তু বেলায় জল আসে। তার উপরে কতক্ষণ থাকে তারও কোনও ঠিক নেই। এ সমস্যা কবে কাটবে কে জানে।”

প্রায় দু’দশক আগে থেকে পুঞ্চায় জলপ্রকল্প চালু হয়। কংসাবতী নদীর ডোঙাবেড়া ঘাটে সাবমার্সিবল পাম্প লাগিয়ে জল তোলা হয়। নদীর ঘাটে মাটির তলায় রিজার্ভার থেকে সরাসরি ওই জল সরবরাহ করা হয়। আলাদা ভাবে উঁচু জলাধার এখানে নেই। সে জন্য বিদ্যুত্‌ চলে গেল জল সরবরাহ বন্ধ থাকে। টানা দু’-তিনদিন জল সরবরাহ বন্ধ থাকার নজিরও রয়েছে। পুঞ্চা পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি কৃষ্ণপদ মাহাতোর অভিযোগ, “পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার পুঞ্চার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য কিছুই করেনি। আমরা জাইকা প্রকল্পের জন্য অপেক্ষা করছি। ওই প্রকল্পে পুঞ্চা বাজার এলাকার জলের সমস্যা তো মিটবেই, এমনকী ব্লকের সমস্ত পঞ্চায়েত এলাকায় জল প্রকল্পের সুবিধা দেওয়া যাবে।” তাঁর আশ্বাস, শীঘ্রই ওই প্রকল্প চালু করা হবে।

বাসিন্দাদের অভিযোগ, জলের সমস্যা দিয়েই বোঝা যায়, এই প্রাচীন জনপদের সামগ্রিক উন্নয়নের হাল কেমন। স্বাস্থ্য পরিষেবা, পরিবহণ ব্যবস্থা, সড়ক যোগাযোগ সবেতেই পিছিয়ে রয়েছে এই এলাকা। বাসিন্দাদের একাংশের মতে, প্রয়াত হরিহর মুখোপাধ্যায় পুঞ্চায় শিক্ষার বিস্তারে অগ্রণী পুরুষদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। মূলত তাঁর উদ্যোগে এলাকায় হাইস্কুল, কলেজ চালু হয়েছিল। কিন্তু উন্নয়নের বাকি ধাপগুলিতে পুঞ্চা একটু পিছিয়েই রয়েছে। পুরুলিয়া জেলার একটা বড় অংশে রেল যোগাযোগ থাকলেও পুঞ্চার বাসিন্দারা তা থেকে বঞ্চিত। তাঁদের ভরসা তাই বাস। কিন্তু পুঞ্চায় স্থায়ী বাসস্ট্যান্ড নেই। রাতে তিন-চারটি বাস এখানে থাকে। জেলা সদর পুরুলিয়া বা বাঁকুড়া শহরে যাওয়ার জন্য মাত্র তিনটি গাড়ি এখান থেকে ছাড়ে। বাকি সব বাস মানবাজার, বান্দোয়ান, বরাবাজার থেকে আসা-যাওয়া করে। সে কারণে পুঞ্চার বাসিন্দারা মাঝপথ থেকে বাসে ওঠায় অনেক সময় বসার জায়গা পান না।

বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, বাসস্ট্যান্ড তো দূরের কথা। পুঞ্চা সদরে শুধুমাত্র থানার সামনে ডাঙায় একটি মাত্র যাত্রী প্রতীক্ষালয় রয়েছে। পুঞ্চা বাজারে আর কোনও প্রতীক্ষালয় তৈরি করা হয়নি। ফলে যাত্রীদের হরিমন্দির চত্বরে অথবা স্থানীয় দোকানে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তবে প্রশাসনের দাবি, পুঞ্চার হরিমন্দির চত্বর এলাকায় জায়গা না মেলায় প্রতীক্ষালয় গড়া যাচ্ছে না। এই ব্লক ১০টি পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত হলে পাঁচটি পঞ্চায়েত এলাকা নদীর ওপারে কেন্দা থানার অধীনে। চাঁদড়া-নোয়াগড়, পানিপাথরের মতো পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দাদের তাই পুঞ্চা ব্লক অফিসে এসে কাজ করতে দিন কাবার হয়ে যায়। পুঞ্চা সদরের সঙ্গে এই সব এলাকার বাসের যোগাযোগ নেই।

পুঞ্চায় ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে বটে তবে বাসিন্দাদের কাছে তা ‘রেফার স্বাস্থ্যকেন্দ্র’ নামেই পরিচিত। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সীমানা প্রাচীর নেই। রোগীদের আত্মীয়দের জন্য প্রতীক্ষালয়ও নেই। ৩০টি শয্যা থাকলেও গড়ে ৬০ জনের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। ব্লক স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, পাঁচ জন চিকিত্‌সকের থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে রয়েছেন মোটে ৩ জন চিকিত্‌সক। নার্সিং স্টাফ অনুমোদিত পদ রয়েছে ৮টি। কিন্তু রয়েছেন ৫ জন। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী একজনও নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্র সাফাই এবং অন্য কাজে সমস্যা মেটাতে আপাতত দৈনিক মজুরিতে একজন লোক নেওয়া হয়েছে। ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও নেই এক্স-রে ব্যবস্থা। ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক সত্যব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “পুঞ্চা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নতুন ভবনের জন্য কয়েকবার জেলা কর্তৃপক্ষকে জানান হয়েছে। অন্যান্য সমস্যার কথাও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানেন। পুঞ্চা ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অধীনে ৩টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে নোয়াগড়, বাগদা ও কুড়ুকতোপা। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের দাবি, বাগদায় ২৪ ঘণ্টা পরিষেবা মেলে। নোয়াগড় ও কুড়ুকতোপা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কিন্তু শুধু বহির্বিভাগ চালু আছে। চিকিত্‌সক পাওয়া গেলে সেখানেও সব সময়ের জন্য পরিষেবা দেওয়া যাবে।

পুঞ্চার দৈনিক সব্জি বাজার বসে হরিমন্দির চত্বরে। এ জন্য সেখানে মাঝে মধ্যে যানজট লেগে থাকে। কয়েক বছর আগে ডাঙায় পঞ্চায়েত অফিসের কাছে বাজার সরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করে প্রশাসন। কিন্তু তা সফল হয়নি। এমনই নানা সমস্যার মধ্যে রয়েছেন পুঞ্চার বাসিন্দারা। তাঁরা বলছেন, আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের দৌত্য এসে রাতারাতি পুঞ্চার সব সমস্যা মেটাতে পারবে না জানি। কিন্তু প্রশাসন ও জন প্রতিনিধিদের সমস্যাগুলি সমাধানের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। পুঞ্চায় কবে আসবে সত্যিকারের পরিবর্তন? পুঞ্চা ব্লক এলাকার বাসিন্দা তথা জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বীকারোক্তি, “জেলার অন্য ব্লক সদরগুলির তুলনায় পুঞ্চার উন্নয়ন পিছিয়ে। এখানকার সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ চেয়ে রাজ্য সরকারের কাছে আগেই অনুরোধ জানিয়েছিলাম। আবার জানাব।”

কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।

ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর পুরুলিয়া-বাঁকুড়া’।

ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp

অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া বিভাগ, জেলা দফতর,

আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar shohor pooncha samir dutta drinking water
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE