টানা তাপপ্রবাহ আশঙ্কা বাড়াচ্ছিল ক’দিন ধরেই। এ বার না জল বন্ধ হয়! সেই আশঙ্কা সত্যি করে বুধবারের সকালে নির্জলাই রইল পুরুলিয়া শহরের বেশির ভাগ ওয়ার্ড।
একে প্রায় সিদ্ধ করে দেওয়া গরম। তার উপরে, সেই কোন ভোর থেকে রাস্তার ধারের কলের জলের জন্য লম্বা লাইনে অপেক্ষা করেও শেষে খালি বালতি হাতেই ঘরমুখো হতে হয়েছে পুরুলিয়াবাসীকে।
পরিস্থিতি এমন যে, এ বার থেকে জল সরবরাহ অনিশ্চিত হতে পারে বলে পুরসভার পক্ষ থেকে মাইকে ঘোষণা করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পানীয় জলের অপচয় বন্ধেরও অনুরোধ জানিয়েছে পুরসভা। এরই পাশাপাশি যাঁদের বাড়িতে জলের সংযোগ রয়েছে, তাঁদের কেউ মূল সরবরাহ লাইন থেকে পাম্প ব্যবহার করে অতিরিক্ত জল টেনে নিলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও সতর্ক করা হয়েছে।
কিন্তু, কেন শেষ এপ্রিলে এমন হাহাকার?
পুরুলিয়া শহরের প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার লোকের বাস। দৈনিক পানীয় জলের চাহিদা ১৪ লক্ষ গ্যালন। এই জলের মূল উৎস শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কংসাবতী নদী। গত অগস্টের প্রথম সপ্তাহের পর থেকে জেলায় বৃষ্টি না হওয়ায় খরার কবলে পড়তে হয়েছে গোটা জেলাকেই। শুকিয়ে মরুভূমির চেহারা নিয়েছে কংসাবতী। নদীগর্ভে বালির স্তরে থাকা জল গভীর নলকূপের মাধ্যমে তুলে এত দিন কোনও রকমে কাজ চালানো হচ্ছিল। কিন্তু, সেই জলও তলানিতে ঠেকেছে টানা তাপপ্রবাহের কারণে। দিন কয়েক ধরে তা-ও পাঁচ লক্ষ গ্যালন করে জল উঠছিল। মঙ্গলবার সেটকুও তোলা যায়নি।
ফলে, বুধবার শহরের বেশির ভাগ ওয়ার্ডেই পানীয় জল সরবরাহ করতে পারেনি পুরসভা। হাতে গোনা দু-চারটি ওয়ার্ড জল পেয়েছে। পুরসভার এক আধিকারিক বলেন, ‘‘ওই দু-চারটি ওয়ার্ডে বোরিংয়ের মাধ্যমে সেই এলাকায় জল তোলা হয়। তাই সেখানে জল দেওয়া গিয়েছে।’’
পুরুলিয়া পুর-এলাকায় পানীয় জল দিতে কংসাবতী তীরে তেলেডি ও শিমুলিয়ায় দু’টি পাম্পিং স্টেশন আছে। তেলেডি থেকে শিমুলিয়ার পাম্পিং স্টেশনটি বেশ খানিকটা নীচের (ডাউনস্ট্রিমে) দিকে। অন্য বার আপস্ট্রিমের উৎস থেকে জলের সরবরাহ খানিকটা কম মিললেও ডাউনস্ট্রিমের উৎসের জল থেকে অবস্থা সামাল দেওয়া হয়। কিন্তু, চলতি মরসুমে অনাবৃষ্টির জেরে ডাউনস্ট্রিমও প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে। পুরসভার জল সরবরাহ বিভাগের দায়িত্বে থাকা ইঞ্জিনিয়ার পার্থসারথি সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘নদীগর্ভে কমবেশি কুড়ি ফুট বালির স্তর রয়েছে। এত দিন সেই বালির স্তরে সঞ্চিত জল টেনে সরবরাহ চলছিল। এখন সেই জলও তলানিতে ঠেকেছে। সে কারণেই এ দিন সকালে জল দেওয়া যায়নি।’’ তিনি জানান, এ বার যেমন যেমন জল সঞ্চিত হবে, সে রকম ভাবে জল সরবরাহ করা হবে। অর্থাৎ, গোটা বিষয়টাই অনিশ্চিত।
এই অবস্থায় দৈনন্দিন কাজ তো দূর, খাওয়ার জল জোগাড় করতেও চরম দুর্ভোগে পড়েছেন এলাকাবাসী। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের স্বাতী দাস, ২৩ নম্বরের রাজীব মাহাতো কিংবা ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায়রা বলেন, ‘‘সকাল থেকে জল আসেনি। এই গরমে পানীয় জল ছাড়া চলবে কী করে!’’
বিকেলেও পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল, পুরসভার কলের পাশে জলের আশায় হত্যে দিয়ে আছেন অনেকে। সার দিয়ে রাখা বালতি, কলসি, জ্যারিকেন। লাইনে থাকা রিতা দাস বললেন, ‘‘সকালে জল আসেনি। বিকেলে যদি আসে, সেই আশায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।’’ জল অবশ্য আসেনি। অনেকেই জানিয়েছেন, আগের দিনের বাঁচিয়ে রাখা জলে এ দিন সকালটা কেটে গিয়েছে। রাতেও জল না এলে, আজ থেকে কী হবে ভেবে আতঙ্কিত তাঁরা। পুরুলিয়া সিটিজেন ফোরামের পক্ষে আবু সুফিয়ানের দাবি, পুরসভাকে যে-ভাবেই হোক জলের ব্যবস্থা করতে হবে।
পুরসভা সূত্রের খবর, গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো শিমুলিয়া পাম্পিং স্টেশনে একটি পাম্পের যন্ত্রাংশ খারাপ হয়ে যাওয়া সমস্যা বাড়িয়েছে। তবে তা দ্রুত মেরামতের কাজ চলছে। পুরুলিয়ার পুরপ্রধান, কে পি সিংহ দেও বলেন, ‘‘মাইকে ঘোষণা করে বলে দেওয়া হয়েছে, কোনও ভাবেই যেন সরবরাহের লাইন থেকে পাম্প ব্যবহার করে অতিরিক্ত জল কেই না টেনে নেন। তেমন ঘটনা নজরে এলে সংশ্লিষ্ট বাড়ির সংযোগ কেটে দেওয়ার পাশাপাশি আইনানুগ ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।’’ শহরের ১৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছায়া দাস বলেন, ‘‘এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলেই সরবরাহের জলে টান পড়ছে। আমরা খেয়াল করে দেখেছি, রাস্তার কলে সরু হয়ে জল পড়ছে। কিন্তু, লোডশেডিং হতেই খানিকটা জোরে জল পড়ছে। এর মানে, কোথাও পাম্প করে টেনে নেওয়া হচ্ছিল জল।’’ তিনি জানান, এ রকম অভিযোগ কিছু জায়গা থেকে আসছে। পুরসভার নজরে আনা হয়েছে।
কিন্তু, আসল প্রশ্ন হল, নদীবক্ষে বালির নীচে সঞ্চিত জলের ভাঁড়ারে টান পড়লে আগামী দিনে কী হবে? পুরপ্রধান জানান, পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেছেন। নদীবক্ষে বালির মধ্যে কুয়ো তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে। সেই প্রকল্প রিপোর্ট দ্রুত পাঠানো হবে, যাতে জরুরি ভিত্তিতে এই কাজ করে ফেলা যায়। পার্থসারথিবাবু জানান, নদীবক্ষে বালির মধ্যে কয়েকটি জলের উৎস রয়েছে। সেখানেই কুয়ো করা হবে।
এ সব জেনে শহরবাসীর প্রশ্ন, এতে তো সময় লাগবে। আপাতত ক’দিন জল না মিললে কী হবে? এর জবাব অবশ্য কারও কাছেই নেই।