Advertisement
০৩ মে ২০২৪
বেগুনকোদরে বিজ্ঞানমঞ্চ

ঠান্ডার রাত কাটল স্টেশনে, ভূত কোথায়

‘গোস্ট ট্যুরিজম’-এর নামেও ব্যবসা করছেন কেউ কেউ। কিন্তু কনকনে ঠান্ডার মধ্যে বৃহস্পতিবার ওই স্টেশনে রাত কাটিয়েও অশরীরিদের দেখা পেলেন না বিজ্ঞান মঞ্চের কর্মীরা। তবে ওই গুজব ছড়ানোর পিছনে যে দুষ্কৃতীদের হাত রয়েছে, সে রহস্যের হদিস মিলেছে স্টেশন লাগোয়া জঙ্গলে।

স্টেশনে: বিজ্ঞান মঞ্চের প্রতিনিধিরা। নিজস্ব চিত্র

স্টেশনে: বিজ্ঞান মঞ্চের প্রতিনিধিরা। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:১৮
Share: Save:

ঘুটঘুটে অন্ধকারে ট্রেন স্টেশন ছাড়লেই সাদা শাড়িতে তারা না কি নেমে আসে। প্ল্যাটফর্ম লাগোয়া ঝাঁকরা মাথার ছাতিম গাছের কাছে গেলে গা না কি ছমছম করে। পুরুলিয়ার বেগুনকোদর স্টেশন ঘিরে এমনই নানা গল্পগাথা শুনে পর্যটকেরাও খোঁজখবর নিতে আসছেন। ‘গোস্ট ট্যুরিজম’-এর নামেও ব্যবসা করছেন কেউ কেউ। কিন্তু কনকনে ঠান্ডার মধ্যে বৃহস্পতিবার ওই স্টেশনে রাত কাটিয়েও অশরীরিদের দেখা পেলেন না বিজ্ঞান মঞ্চের কর্মীরা। তবে ওই গুজব ছড়ানোর পিছনে যে দুষ্কৃতীদের হাত রয়েছে, সে রহস্যের হদিস মিলেছে স্টেশন লাগোয়া জঙ্গলে।

দক্ষিণ-পূর্ব রেলের কোটশিলা-মুরি শাখায় ছোট্ট স্টেশন বেগুনকোদর চালু হয় ১৯৬০ সালে। বেগুনকোদর, দঙ্গল, বামনিয়া, বেলাডি, ডুড়কু, কানুডি, পাতরাহাতু-সহ আশপাশের গ্রামগুলির বাসিন্দাদের এতে উপকার হয়েছিল। কিন্তু রাত নামলেই ধু ধু ধানখেত আর ছোট্ট জঙ্গল ঘেরা এই স্টেশনে ভূতের উপদ্রব শুরু হয় বলে গুজব রয়ে যায়। মাঝে মধ্যে না কি, অন্ধকারের বুক চিরে আলোর রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। এমনকি ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সঙ্গে মিশে যায় অদ্ভুত সব শব্দ। রেলকর্মীরা সেখানে কাজ করতে আপত্তি তোলেন। পরিস্থিতি এমন হয় যে চালু করার সাত বছরের মাথায় বেগুনকোদর স্টেশনটি বন্ধ করে দেয় রেল। তবে ওই স্টেশনের উপর দিয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়নি।

এতে সমস্যায় পড়েন বাসিন্দারা। তবে জেলার বাসিন্দা সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া রেলওয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান থাকার সময়ে বেগুনকোদর স্টেশনটি ফের চালু করার দাবি তোলেন। ২০০৭ সালে শুরু হয় ট্রেন চলাচল। বাসিন্দারাও খুশি হন।

কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ফের ওই স্টেশনকে ঘিরে গুজব ছড়াতে শুরু করে। সোশ্যাল সাইটের দেওয়াল বেয়ে হু হু করে সেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে। পর্যটকেরাও উঁকি ঝুঁকি মারতে শুরু করেন। এই সুযোগে কেউ কেউ পর্যটকদের বেগুনকোদর স্টেশন ঘোরানোর নাম করে গোস্ট ট্যুরিজমের ব্যবসাও ফেঁদে ফেলেন।

কিন্তু এতে তীব্র আপত্তি রয়েছে বাসিন্দাদের। বেগুনকোদরের বাসিন্দা তপনকুমার বিদ বলছেন, ‘‘যত সব আজগুবি ব্যাপার। মনে হয়, বদ মতলবে স্টেশনটি কারা ফের বন্ধ করতে চাইছে।’’ বেগুনকোদরের বাসিন্দাদের পাশে দাঁড়িয়ে ওই গুজব ভাঙতেই বৃহস্পতিবার রাতে পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া জেলা কমিটির সম্পাদক নয়ন মুখোপাধ্যায় জনা দশেক সদস্যকে নিয়ে ওই স্টেশনে ঘাঁটি গাড়েন। নয়নবাবু বলেন, ‘‘এই প্রত্যন্ত এলাকায় রেলকর্মীরা আসতে চাইতেন না বলেই হয়তো ওই গুজব রটেছিল। কিন্তু এখন চারপাশ বদলে গিয়েছে। রাতেও অনেকে ট্রেন থেকে নামেন। তারপরেও ফের গুজব চাউর হওয়ার কোনও কারণ নেই।’’

রাতে যদি অদ্ভুত কিছু ঘটে, সে জন্য তাঁরা নানা রঙের আলো জ্বালিয়ে ক্যামেরাও তাক করে রেখেছিলেন। সারা রাত তাঁরা প্লাটফর্মের মধ্যে গল্পগুজব করে রাত কাটালেন। কিন্তু গুজব বাস্তব হয়নি। একের পর এক মালগাড়ি, যাত্রিবাহী ট্রেন অন্ধকারের বুক চিরে পার হয়ে গেলেও ট্রেনের পিছনে দেখা মেলেনি কোনও সাদা কাপড় পরিহিত ছায়ামূর্তির। অথচ রটনা এমনই।

নয়নবাবু বলেন, ‘‘গল্প গুজবের মাঝেই দূরে দেখা গেল লাইন বরাবর দুটো আলো এগিয়ে আসছে। কাছে আসার পরে বোঝা গেল, তাঁরা লাইনম্যান। রেললাইন পরীক্ষা করা তাঁদের দৈনন্দিন কাজ। জিজ্ঞেস করে জানলাম, কোনওদিন তাঁরা অশরীরি তো দূর অস্ত্‌, তেমন অস্বাভাবিক কিছুই দেখেননি।’’

জিআরপি-র সিভিক ভলান্টিয়ার স্টেশন লাগোয়া বেলাডি গ্রামের বাসিন্দা চিন্ময় কুমার রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত স্টেশনে ডিউটি করেন। তাঁরও এক কথা— ‘‘কোনও দিন ভূত-প্রেতের দেখা পাইনি।’’ স্টেশনের টিকিট বিক্রেতা অমূল্যরতন মাহাতো বলেন, ‘‘রাতে আসানসোল থেকে আসা লোকাল ট্রেনেও অনেকে নামেন। তাঁরাও কেউ কোনও অশরীরিকে দেখেননি। সবই গুজব।’’

শেষ বেলায় ভোর চারটের দিকে অবশ্য রহস্য ছড়িয়ে জঙ্গল থেকে ভেসে এসেছিল অদ্ভুত একটা শব্দ। নয়নবাবুর কথায়, ‘‘শব্দ ধরে এগোতেই দেখি অন্ধকারের মধ্যে যেন দু’জোড়া চোখ জ্বলছে। পুলিশকে নিয়ে সেখানে পৌঁছতেই দেখি কয়েকজন দুদ্দাড় করে দৌড়ে পালিয়ে গেল। কাছে গিয়ে দেখি, সেখানে মদের বোতল, তাস পড়ে রয়েছে। বুঝতে পারছি, গুজব রটাতে এ সব করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে দুষ্কৃতীরা। তাদের কী মতলব কে জানে!’’ তিনি জানিয়েছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা ও সুপারিশ প্রশাসন ও রেলের কাছে পাঠাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE