Advertisement
০৪ মে ২০২৪
তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার পাত্রসায়র

অভিযোগের অন্ত নেই, শুধু গ্রেফতারই হয় না

বেলিয়াতোড়ে যখন কলেজ দখলের লড়াই, পাত্রসায়রে তখন এলাকা দখলের। লোকসভা ভোটে বিপুল সাফল্যের পরে দলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াইটাই এখন বাঁকুড়া জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের মাথাব্যথার কারণ। স্থানীয় বাসিন্দাদের তো বটেই। সেই দ্বন্দ্বেরই জেরে এক দিকে বেলিয়াতোড় কলেজে সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, অন্য দিকে পাত্রসায়রে দলের দুই গোষ্ঠীর কর্মীরা ব্যস্ত নিজেদের মধ্যে মারামারিতে।

তাণ্ডবের পরে বালসির ব্যাঙ্ক মোড়ে তৃণমূলের বালসি ২ অঞ্চল কার্যালয়। শুক্রবার ছবিটি তুলেছেন দেবব্রত দাস।

তাণ্ডবের পরে বালসির ব্যাঙ্ক মোড়ে তৃণমূলের বালসি ২ অঞ্চল কার্যালয়। শুক্রবার ছবিটি তুলেছেন দেবব্রত দাস।

নিজস্ব সংবাদদাতা
পাত্রসায়র শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৪ ০১:০৬
Share: Save:

বেলিয়াতোড়ে যখন কলেজ দখলের লড়াই, পাত্রসায়রে তখন এলাকা দখলের। লোকসভা ভোটে বিপুল সাফল্যের পরে দলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার লড়াইটাই এখন বাঁকুড়া জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের মাথাব্যথার কারণ। স্থানীয় বাসিন্দাদের তো বটেই।

সেই দ্বন্দ্বেরই জেরে এক দিকে বেলিয়াতোড় কলেজে সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, অন্য দিকে পাত্রসায়রে দলের দুই গোষ্ঠীর কর্মীরা ব্যস্ত নিজেদের মধ্যে মারামারিতে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত বালসি এলাকায় পাত্রসায়র ব্লক তৃণমূল সভাপতি স্নেহেশ মুখোপাধ্যায় এবং ব্লকের আর এক নেতা নব পালের অনুগামীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ বাধে। বালসির ব্যাঙ্ক মোড়ে তৃণমূলের বালসি ২ অঞ্চল কার্যালয়ে ভাঙচুর, মারধরের অভিযোগ দায়ের হয়েছে নব পাল-সহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে। হামলার পাল্টা অভিযোগ হয়েছে স্নেহেশ-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও।

এর আগেও একাধিকবার দুই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছে। কিন্তু, এত কিছুর পরেও পুলিশ এক জনকেও না ধরায় জেলা পুলিশের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন এলাকার বাসিন্দারা। একই সঙ্গে, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামাল দিতে তৃণমূলের জেলা নেতাদের ‘উদাসীনতা’ ও ‘ব্যর্থতা’র অভিযোগ উঠছে দলের অন্দরেও।

বাঁকুড়া জেলা তৃণমূলের কো-চেয়ারম্যান তথা জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীর হুঁশিয়ারি, “যে বেশি বাড়বে, সেই পড়বে! দলের মধ্যে কোনও রকম বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করা হবে না। দল সবার কাজের প্রতি নজর রাখছে। সময় হলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

পাত্রসায়রের সাধারণ মানুষের অবশ্য প্রশ্ন, দল যদি নজরেই রাখে, তা হলে গত কয়েক মাসে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছল কী করে? তাঁদের আরও বক্তব্য, এলাকা প্রায় বিরোধীশূন্য। সিপিএম নেই। বিজেপি থাকলেও তাদের সংগঠন আহামরি কিছু নয়। পাত্রসায়র ব্লকের ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি থেকে জেলা পরিষদের আসন সবই তৃণমূলের দখলে। তা সত্ত্বেও শাসকদলের গোষ্ঠী সংঘর্ষে ছেদ পড়ছে না। স্থানীয় সূত্রের খবর, লোকসভা ভোটের পর থেকেই পাত্রসায়রের বাসস্ট্যান্ড, বালসি, মৌকুচি, বামিরা, বেতুড়, ধগড়িয়া, ইদিলচক, কাঁটাদিঘি এলাকায় প্রতি রাতেই মুখ ঢাকা কিছু সশস্ত্র লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। লাঠি, রড, টাঙির পাশাপাশি ওই দুষ্কৃতীদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র, বোমাও থাকছে। যে এলাকায় যে গোষ্ঠীর প্রভাব বেশি, তারা বিরোধী গোষ্ঠীর লোকজনকে ভয় দেখানোর জন্যই এ সব করছে বলে অভিযোগ। দুষ্কৃতীদের দাপাদাপি, মুড়ি মুড়কির মতো বোমাবাজি ও গুলির শব্দে রাতের ঘুম উড়েছে এলাকাবাসীর। পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক যে তৃণমূলের পার্টি অফিস পাহারা দিতে হচ্ছে পুলিশকে। গ্রামে গ্রামে পুলিশবাহিনী মোতায়েন করতে হচ্ছে। এরই পাশাপাশি নিজেদের পেশিশক্তি দেখানোর জন্য চলছে মিছিল, সভা। ফলে প্রায়দিনই সন্ধ্যার পর থেকেই এলাকার রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। সাত তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দোকানপাট। ব্যবসা মার খাচ্ছে। সব মিলিয়ে চরম আতঙ্কে এলাকার মানুষ।

বৃহস্পতিবারও তেমন অশান্তি চাক্ষুষ করেছেন বালসি অঞ্চলের বাসিন্দারা। তৃণমূলের বালসি ২ অঞ্চল অফিসে ব্যাপক ভাঙচুর হয়। আগের অনেক অশান্তির মতো এ ক্ষেত্রেও পুলিশ কাউকে ধরেনি। অথচ, হামলা-পাল্টা হামলা হলেই যুযুধান দুই গোষ্ঠীর তরফে থানায় অভিযোগ হচ্ছে। কিন্তু, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে পুলিশ কাউকেই গ্রেফতার করছে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, পুলিশ একটু সক্রিয় হয়ে ধরপাকড় শুরু করলেই সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় তৃণমূলের একাংশও।

ব্লক তৃণমূল সভাপতির অনুগামী, বালসি ২ পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান বুদ্ধদেব পাল এবং ওই পঞ্চায়েতের সদস্য শেখ মিরাজের অভিযোগ, “নব পালের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা বৃহস্পতিবার যখন আমাদের পার্টি অফিসে অতর্কিতে হামলা চালায়, তখন সেখানে পাত্রসায়র থানার এএসআই কুন্তলকান্তি সিংহের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী হাজির ছিল। অথচ পুলিশের সামনেই দুষ্কৃতীরা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাট আউট, দলীয় পতাকা, ফেস্টুন লাথি মেরে ফেলে দেয়। অফিসের সামনে রাখা আমাদের মোটরবাইক ও সাইকেল ভেঙে তছনছ করে দেয়। সিপিএমের লোকেরা এক সময় যা করত, এখন নব পালের দলবল সেটাই করেছে, পুলিশ শুধু দাঁড়িয়ে দেখেছে।” হামলার প্রতিবাদে এবং অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবিতে শুক্রবার বিকেলে বুদ্ধদেববাবুর নেতৃত্বে এলাকায় মিছিল করেন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা।

নববাবুর অভিযোগ, বামিরা গ্রামে তাঁদের গোষ্ঠীর পার্টি অফিস ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিল বুদ্ধদেব পাল, শেখ মিরাজ, শিবু মিদ্যার আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। পুলিশ ওই ঘটনাতেও কাউকে ধরেনি। তিনি বলেন, “এলাকায় বারবার আমাদের লোকদের উপরে হামলা হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ কিছুই করেনি।”

পুলিশের পাশাপাশি দলের উচ্চ নেতৃত্বের ভূমিকাতেও ক্ষুব্ধ নিচুতলার কর্মীরা। তাঁদের অনুযোগ, গোষ্ঠী-বিরোধ মেটাতে চরম উদাসীন জেলা নেতারা। তারই মাসুল গুনতে হচ্ছে এলাকার মানুষকে। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার মুকেশকুমারকে এ দিন বারবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে, জেলা পুলিশের এক আধিকারিক দাবি করেন, যে কোনও ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ পাঠানোয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রাতে মুখ ঢাকা লোকজনের আনাগোনার খবর জানা নেই। অভিযোগের তদন্ত করে অভিযুক্তদের ধরার চেষ্টা চলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

group clash tmc parasayar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE