Advertisement
০৬ মে ২০২৪
খুনে যাবজ্জীবন মনিরুল ঘনিষ্ঠদের

আতঙ্কে আদালতে এলেন না বাড়ির কেউ

মেয়েকে দিতে যাওয়ার পথে দূরের মাঠটার দিকে অজানতেই দৃষ্টি চলে যায় মায়ের। জলে ভিজে যায় দু’চোখ। কিন্তু কাঁদতে পারেন না কখনও। যদি সেই কান্না দেখে মেয়ের চোখও ভিজে যায় কান্নায়! দু’বছর ধরে এই বোবা কান্নাই বয়ে বেড়াচ্ছেন বছর তিরিশের সীমা মণ্ডল। লাভপুরে নিহত তৃণমূল কর্মী চিত্তরঞ্জন মণ্ডলের বিধবা স্ত্রী। স্থানীয় ব্রাহ্মণী গ্রামের বাসিন্দা চিত্তরঞ্জনবাবু ছিলেন, তৃণমূলের বিপ্রটিকুরী বুথ কমিটির সভাপতি।

(বাঁ দিকে) গোপাল শেখ ও (ডান দিকে) সামাদ শেখ। —নিজস্ব চিত্র

(বাঁ দিকে) গোপাল শেখ ও (ডান দিকে) সামাদ শেখ। —নিজস্ব চিত্র

অর্ঘ্য ঘোষ
লাভপুর শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৩০
Share: Save:

মেয়েকে দিতে যাওয়ার পথে দূরের মাঠটার দিকে অজানতেই দৃষ্টি চলে যায় মায়ের। জলে ভিজে যায় দু’চোখ। কিন্তু কাঁদতে পারেন না কখনও। যদি সেই কান্না দেখে মেয়ের চোখও ভিজে যায় কান্নায়!

দু’বছর ধরে এই বোবা কান্নাই বয়ে বেড়াচ্ছেন বছর তিরিশের সীমা মণ্ডল। লাভপুরে নিহত তৃণমূল কর্মী চিত্তরঞ্জন মণ্ডলের বিধবা স্ত্রী। স্থানীয় ব্রাহ্মণী গ্রামের বাসিন্দা চিত্তরঞ্জনবাবু ছিলেন, তৃণমূলের বিপ্রটিকুরী বুথ কমিটির সভাপতি। চিত্তরঞ্জন খুনের অভিযোগ নিয়ে তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দল সে সময় প্রকট হয়ে পড়ে। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল, এলাকার বিধায়ক মনিরুলের বিরোধী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত তদানীন্তন জেলা সম্পাদক দেবাশিস ওঝার অনুগামী চিত্তরঞ্জনকে গোপাল এবং তার শাগরেদরা খুন করেছিল।

তৃণমূলের অন্দরের সে সময়ই ব্যাখ্যা ছিল, বিধানসভা ভোটে লাভপুর কেন্দ্রের টিকিট পাওয়া নিয়ে বর্তমান এলাকার তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলাম এবং দলের জেলা সম্পাদক, লাভপুরের বাকুল গ্রামের বাসিন্দা দেবাশিস ওঝার মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। মনিরুল এক সময় ফরওয়ার্ড ব্লক করতেন। ২০০৯-এর লোকসভা ভোটের পরে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের উপস্থিতিতে ওই দলে যোগ দেন। লাভপুর বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থীপদের অন্যতম দাবিদার দেবাশিসবাবুর অনুগামীদের অভিযোগ, বিশেষ ‘বোঝাপড়া’-র ভিত্তিতে অনুব্রতবাবু মনিরুলকে টিকিট পাইয়ে দেন। এ দিন মনিরুলবাবুকে বারবার ফোন করলে তিনি ফোন ধরেননি। এমনকী, এসএমএসেরও উত্তর দেননি।

কী হয়েছিল সে দিন?

সে দিনের ঘটনা মনে পড়লেই সামনে এসে দাঁড়ায় রক্তাক্ত সেই দৃশ্যগুলো। ২০১২ সালের ১৭ নভেম্বর। সে দিন লাগোয়া আমনাহার গ্রামে মুনিষ দেখতে যাওয়ার পথে, কাশিয়ারা প্রাথমিক বিদ্যালয় লাগোয়া সাঁইথেডাঙ্গায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন চিত্তরঞ্জনবাবু। প্রথমে বোলপুর, পরে বর্ধমান মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। সেখান থেকে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার পথে মৃত্যু হয় তাঁর। ব্রাহ্মণী গ্রাম থেকেই আবছা নজরে আসে সাঁইথেডাঙ্গা। গ্রামে ঢোকার মুখেই প্রাথমিক স্কুল। প্রায় অধিকাংশ দিনই চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী মেয়ে বৃষ্টিকে স্কুলে নিয়ে আস-যাওয়া করেন সীমাদেবী। আর তখনই নজর চলে যায় অদূরের সাঁইথেডাঙ্গার দিকে। বছর দু’য়েক আগে যে ডাঙ্গা থেকে তাঁর স্বামীর রক্তাক্ত দেহটা তুলে এনেছিলেন লোকজন। এখনও মনে পড়লেই, গুমরে ওঠেন সীমাদেবী। কিন্তু কাঁদতে পারেন না। সঙ্গে মেয়ে থাকে যে!

“জানেন, দু’বছর ধরে মন খুলে কাঁদতেও পারিনি! কাঁদলেই মেয়ে জিজ্ঞাসা করে ওঠে, কাঁদছ কেন মা? কি হয়েছে তোমার? তুমিই তো বলেছ, বাবা একদিন ফিরে আসবে! বাবা কবে আসবে মা?”

এ দিন অবশ্য চোখের জল বাঁধ মানেনি। অঝরে কেঁদেছেন সীমাদেবী। চিত্তরঞ্জনবাবুর পরিবারের সকলের চোখেই জল। সবার কান্না দেখে, ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে কেমন যেন চুপ করে গিয়েছে ছোট্ট বৃষ্টিও! শনিবার বেলা বারোটা নাগাদ, আদালতের রায়ের খবর এসে পৌঁছয় ফোনে। বড় রকম সাজা যে একটা হবেই, সে আভাস মিলেছিল, গতকাল দুই অন্যতম অভিযুক্তকে আদালত দোষী সাব্যস্ত করার পরেই। এ দিন বেলা বারোটা নাগাদ গিয়ে দেখা গেল, প্রতিবেশীরা ভিড় করে রয়েছেন চিত্তরঞ্জনের বাড়িতে। ঘন ঘন ফোনে বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর দেওয়া-নেওয়া চলছে। এরইমধ্যে গোপাল এবং সালামের সাজার খবরটা পাওয়ার পরই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না সীমাদেবী। ডুকরে উঠলেন চিত্তরঞ্জনের মা ৬৫ বছরের মণিমালা মণ্ডলও। বৃষ্টির সামনেই কার্যত কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তাঁরা। কাঁদতে কাঁদতেই তাঁরা বলেন, “এই দিনটার জন্যই প্রতীক্ষায় ছিলাম। ওদের ফাঁসি হলে আরও খুশি হতাম। তবে এই রায়ে কিছুটা হলেও মনে শান্তি পেয়েছি।”

রায় বের হওয়ার দিন আদালতে যেতে না পারার প্রসঙ্গে মণিমালাদেবী বললেন, “ইচ্ছা ছিল আদালতে গিয়ে, সাজা শোনার। কিন্তু হামলার আশঙ্কায় যেতে পারিনি। ২৯ জন অভিযুক্তের এখনও অনেকেই যে বাইরে রয়েছেন।” মণিমালাদেবী জানান, ওরা চড়াও হতে পারে এই ভয়েই তাঁরা আদালতে যাওয়ার সাহস পাননি।

শুধু পরিবারের লোকেরাই নয়, গোপাল এবং তার শাগরেদের এই সাজায় উল্লসিত লাগোয়া বুধুরা, কাশিয়ারা, গোপটা, ইন্দাস, বিপ্রটিকুরী-সহ এলাকার অধিকাংশ মানুষ। শনিবার মিলল সেই ছবিও। ব্রাহ্মণী গ্রামের জীবন মাঝি, সনকা পালরা বলেন, “এমন কোনও কু-কর্ম নেই যা গোপাল আর তার সাগরেদরা এলাকায় করেনি। অথচ দিনের পর দিন আমাদের মুখ বুজে ওই অত্যাচার সইতে হয়েছে।” গোপালের সাজা শুনে খুশি চিত্তরঞ্জনের বাবা ধ্বজাধারী মণ্ডল। সেদিনের ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রাজীব ঘোষও। ২০১৩ সালে চিত্তরঞ্জন খুনে অভিযুক্ত সেন্টু কাজী খুনে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে এই ধ্বজাধারীবাবু ও রাজীব-সহ এলাকার আরও ২৯ জনের বিরুদ্ধে। তাঁদের মধ্যে চারজন ধরা পড়ে। জামিনও পায়। কিন্তু আত্মগোপন করে রয়েছেন বাকি অভিযুক্তদের সঙ্গে রাজীব এবং ধ্বজাধারী বাবুরা।

এ দিন ফোনে তাঁরা জানান, “জনরোষে মৃত্যু হয় সেন্টু কাজীর। কিন্তু চিত্তরঞ্জন খুনের মামলা থেকে আমাদের সরে দাঁড়ানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করতেই মিথ্যা খুনের অভিযোগে জড়ানো হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

samad sheikh gopal sheikh labhpur arghya ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE