তাণ্ডবের চিহ্ন। পড়ে আছে আসবাপত্রের ভাঙা টুকরো।
ক্ষোভ জমছিলই। তারই চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটল শুক্রবার।
রেশন ডিলারের বাড়িতে চড়াও হয়ে ভাঙচুরের পরে লুঠপাট চালালেন কয়েকশো গ্রামবাসী। পুরুলিয়ার আড়শা ব্লকের কুদাগারা গ্রামের ঘটনা। এ দিন সকাল ৮টা নাগাদ কয়েকশো মানুষ গ্রামেরই রেশন ডিলার দেবেন্দ্রনাথ কুমারের বাড়িতে লাঠিসোটা, রড, শাবল নিয়ে হামলা চালান। অভিযোগ, বাড়ির পাখা, ফ্রিজ, আলমারি ভাঙচুরের পাশাপাশি দোকান থেকে চাল, গম লুঠ করা হয়। মজুত থাকা কেরোসিন মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। নগদ টাকা ও গয়নাও লুঠ হয়। ঘণ্টাখানেক ধরে তাণ্ডব চলার পরে খবর পেয়ে পুলিশ গ্রামে পৌঁছনোর আগেই হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।
প্রশাসন সূত্রের খবর, জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের জন্য দু’টাকা কেজি দরে মাথাপিছু দু’কেজি করে চাল বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু, বেশ কিছুদিন ধরে দু’কেজির বদলে গ্রাহকদের কম চাল দেওয়া হচ্ছে, এই অভিযোগে সরব হয়েছেন পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলের গ্রাহকদের একাংশ। প্রতিবাদে কোথাও পথ অবরোধ, কোথাও খাদ্য দফতরের কর্মীদের ঘেরাওয়ের মতো দু-একটি ঘটনা ঘটলেও কোনও রেশন ডিলারের বাড়িতে তাণ্ডবের ঘটনা এই প্রথম। গ্রামবাসীদের ক্ষোভ আগামী দিনে আরও তীব্র চেহারা নেবে কি না, এখন সেটাই মাথাব্যথা হয়ে উঠতে পারে জেলা পুলিশ-প্রশাসনের। এই ঘটনার পরে এ দিন জেলা প্রশাসনের পদস্থ কর্তা, পুলিশ ও খাদ্য দফতরের আধিকারিকেরা বৈঠক করেন।
অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) সবুজবরণ সরকার বলেন, “গণবন্টন ব্যবস্থা নিয়ে কোথাও কোনও ধরনের অভিযোগ রয়েছে কি না, তা জানতে শনিবার জেলার সব ব্লকের বিডিওদের নিয়ে বৈঠক হবে।” জেলা খাদ্য নিয়ামক লতিফউদ্দিন শেখ বলেন, “শুনেছি যে, ওই রেশন ডিলার চলতি সপ্তাহে কোন মাল তোলেননি।” পুরুলিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দ্যুতিমান ভট্টাচার্য জানান, ডিলার থানায় অভিযোগ করেছেন। পুলিশ হামাকারীদের খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছে।
এ দিন অযোধ্যা পাহাড়ের অদূরে কুদাগারা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, থমথমে পরিবেশ। পুলিশ টহল দিচ্ছে। গ্রামের লোকজন মুখে কুলুপ এঁটেছেন। রেশন ডিলারের যে বাড়িটিতে ভাঙচুর চালানো হয়েছে, সেখানেই রেশন দোকান। তছনছ হয়ে মেঝেতে পড়ে রয়েছে চাল, গম, কেরোসিন, আসবাবপত্রের ভাঙা টুকরো। ডিলার দেবেন্দ্রনাথবাবু বলেন, “আমি এ দিন বাড়িতে ছিলাম না। আমি নিজে আর আমার মা অসুস্থ। চিকিৎসার কারণে বাইরে রয়েছি। তবে শুনেছি, আমার বাড়িতে কয়েকশো লোক ভাঙচুর আর লুঠপাট চালিয়েছে।” তাঁর আরও দাবি, চলতি সপ্তাহে তিনি যে মাল তুলতে পারব না, তা খাদ্য দফতরকে লিখিত ভাবে জানিয়েছিলেন।
বাড়ি ও দোকানে ভাঙচুরের পরে।
কেন এই হামলা, সে প্রশ্নের জবাবে রেশন ডিলার বলেন, “তা বলতে পারব না। তবে, কিছু লোক কয়েক দিন ধরে আমার কাছে দাবি জানিয়েছিল, মাথাপিছু দু’কেজি করে চাল দিতে হবে।” দেবেন্দ্রনাথবাবুর পরিবারের এক সদস্যের দাবি, তাঁরা গ্রাহকদের বলেছিলেন, যে পরিমাণ মাল (চাল) অন্য দোকানে দেওয়া হচ্ছে, এখানেও ততটা দেওয়া হচ্ছে। দেবেন্দ্রনাথবাবু কথায়, “পুরো দু’কেজি করে চাল কী ভাবে দেওয়া সম্ভব? যত কার্ড রয়েছে, তার চেয়ে কম মাল পাওয়া যায়। তাই বণ্টনের সময় মাথাপিছু কিছুটা করে কম পড়ে। সে কথাই আমরা গ্রাহকদের বলি।” রেশন ডিলারের ভাই নারায়ণ কুমার জানান, হামলার সময় তাঁরা তাঁদের অন্য বাড়িতে ছিলেন। খবর পেয়ে দূর থেকে দেখেন, অনেক লোক বাড়ির বাইরে। হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পরে গিয়ে দেখেন, সব তছনছ। দোকানে মজুত গণবণ্টনের চাল, গম সব লুঠ হয়েছে। টাকা, গয়নাও লুঠ হয়েছে বলে ওই পরিবারের অভিযোগ।
ডিলারের বাবা মন্মথ কুমার বলেন, “মাল কম পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ থাকলে গ্রাহকেরা, খাদ্য দফতরে জানাতে পারতেন। এ ভাবে বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুঠ করার কী অর্থ!” এ দিনের ঘটনার পর থেকে গোটা পরিবারই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
চলতি সপ্তাহেই বাঘমুণ্ডিতে খাদ্য দফতরের আধিকারিককে দিনভর ঘেরাও করেন রেশন গ্রাহকেরা। সে ক্ষেত্রেও দু’টাকা কেজি দরে চাল বরাদ্দের চেয়ে কম পাওয়ার অভিযোগ ছিল গ্রাহকদের। বৃহস্পতিবার আড়শারই হেঁসলা মোড়ে একই অভিযোগে পুরুলিয়া-আড়শা সড়ক ঘণ্টা তিনেক অবরোধ করেন এলাকার বাসিন্দারা। এ বার খোদ রেশন ডিলারের বাড়িতেই এমন হামলার পরে রেশন নিয়ে ক্ষোভ বেড়ে চলার ইঙ্গিত পাচ্ছেন প্রশাসনিক কর্তারা। ওয়েস্ট বেঙ্গল এম আর ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন মাহাতো বলেন, “এটা দুঃখজনক ঘটনা। ওই রেশন ডিলার চিকিৎসার কারণে বাইরে রয়েছেন। তবে আমিও শুনেছি, জঙ্গলমহলের বরাদ্দ মাথাপিছু দু’কেজি করে চালের বদলে কিছুটা করে কম চাল দেওয়া হচ্ছে। প্রশাসন এই বিষয়টি দেখুক।”
ছবি: সুজিত মাহাতো
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy