সবাই মিলে। শোলার সাজ তৈরিতে ব্যস্ত শিল্পীরা।
ওড়িশা, চক্রধরপুর ও কর্নাটকের দুর্গাপ্রতিমা সাজছে পুরুলিয়ার শিল্পীদের তৈরি শোলার অলঙ্কারে। থিমের প্রতিমার চল শহরাঞ্চল ছাড়িয়ে মফস্সলে ঢুকে পড়লেও গ্রামাঞ্চলের মণ্ডপে এখনও সাবেকি দুর্গাপ্রতিমার পুজো হয়। কাজেই শোলার অলঙ্কারের কদর এখনও ফুরিয়ে যায়নি। পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলার শোলার শিল্পীরা শেষ মুর্হূতে তাই প্রায় নাওয়াখাওয়া ভুলে শোলার সাজ তৈরিতে ব্যস্ত।
পুরুলিয়ার নাপিত পাড়ায় প্রায় ৪০ বছর ধরে শোলার অলঙ্কার তৈরি করে আসছেন বেলারানি যোগী ও তাঁর ছেলে সনাতন যোগী। এখন সনাতনবাবুর দুই ছেলেও সেই কাজে হাত লাগিয়েছেন। তাঁদের তৈরি শোলার সাজ এ বার পুরুলিয়া জেলার গণ্ডি ছাড়িয়ে ভিন্ রাজ্যের মণ্ডপে পাড়িয় দিয়েছে। সনাতনবাবুর কথায়, “বাঘমুণ্ডির চড়িদার মুখোশ শিল্পীদের ওড়িশা, চক্রধরপুর ও কর্নাটকের পুজো উদ্যোক্তাদের ভাল যোগাযোগ রয়েছে। কাজের সুবাদে মুখোশ শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় বরাত পাওয়া গিয়েছে।” তিনি জানান, বাইরের কাজ হলে রোজগার কিছুটা বাড়ে। কিন্তু জেলার কাজে বেশি লাভ রাখা যায় না।
বেলারানিদেবী জানান, আগে ডাকসাজের কদর ছিল। কিন্তু সেই কাজের খাটনি যেমন বেশি, কাঁচামালের দামও অনেক বেশি। তাই রাংতার সাজের প্রচলন হতেই এখন ডাকসাজের বরাত কমে গিয়েছে। বেড়ে গিয়েছে শোলার সাজের কাজ। তাঁর কথায়, “এতে আমাদের পরিশ্রম কমেছে ঠিকই, তবে কাজ আরও চকচকে হয়েছে। দর্শণার্থীরাও মণ্ডপে এসে প্রতিমা দেখে খুশি হন।”
তাঁরা এ বার ভিন্ রাজ্য ছাড়াও প্রতিবারের মতোই পুরুলিয়া শহর ও ঝালদার বেশ কয়েকটি পুজো মণ্ডপে শোলার সাজের কাজ পাঠাচ্ছেন। সব মিলিয়ে ২০টি প্রতিমা সাজানোর বরাত এসেছে এই যোগী পরিবারে। সাকুল্যে প্রায় লাখ দেড়েক টাকার কাজ। তাঁরা প্রতিটি মণ্ডপ থেকে কাজের জন্য সর্বনিম্ম ৫০০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা নেন। সনাতনের কথায়, “পুজোর ক’টা মাসই তো যে টুকু রোজগার। তাই পুজো ফুরিয়ে গেলেই মন খারাপ হয়ে যায়।”
আগমণীর মধ্যেই একইরকম বিষাদের সুর বাঁকুড়া শহরের ইদ্গাহ মহল্লার ডাক শিল্পী রামু মালাকারের ঘরেও। পাঁচ পুরুষ ধরে তাঁরা এই কাজ করে আসছেন। তাঁদের পরিবারের নবকুমার মালাকার প্রথম এই পেশায় আসেন। তাঁদের নির্দিষ্ট কয়েকটি মণ্ডপ বাঁধা রয়েছে। প্রতিবারের মতো এ বারও সেখানেই শোলার সাজ তাঁরা পাঠাচ্ছেন। রামুবাবু জানান, বাঁকুড়া শহরের ধীবর ষোলোআনা, পোদ্দার ষোলোআনা, রক্ষিত ষোলোআনা, রামপুর সুকান্ত স্ট্যাচুর মণ্ডপে পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি মণ্ডপের কাজ অনুযায়ী আলাদা আলাদা দর থাকে। কোথাও ২০০০, কোথাও ৩০০০ টাকার কাজ হয়।
তবে কাঁচামালের দাম বেড়ে যায়, সব মিলিয়ে ১০ হাজারের বেশি রোজগার হয় না বলে তিনি জানান। রামুবাবুর সঙ্গে স্ত্রী জয়া, দুই মেয়ে রিয়া ও বর্ষা হাত লাগায়। তারা স্কুলে পড়ার ফাঁকেই বাবাকে সাহায্য করছে। পুজো কমিটিগুলির কাছ থেকে অগ্রিম বাবদ পাওয়া টাকা থেকে মহালয়ার দিনেই মেয়ে ও স্ত্রী-র জামা-কাপড় কিনে এনেছেন রামুবাবু।
বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী ও বিষ্ণুপুরের আরও কয়েকটি পরিবার এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। এই পেশার সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের আক্ষেপ, গত ১০ বছরে খরচ ১০ গুণ বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু পুজো উদ্যোক্তারা সে তুলনায় দাম বাড়ায়নি। তবুও এই রোজগারই বড় ভরসা। বছরের বাকি সময় কালী, সরস্বতী, কার্তিকের মতো দেব-দেবীর প্রতিমার সাজ তৈরি করেন তাঁরা। কিন্তু তার রোজগার আর কতটুকু! সংসার চালাতে ভরসা বর-কনের টোপর আর চাঁদমালা।
তাই সপ্তমীর দিন থেকেই আগামী বছরের পুজোর জন্য দিন গোনেন শোলার সাজ শিল্পীরা।
পুরুলিয়ার নাপিত পাড়া ও বাঁকুড়ার ইদ্গাহ মহল্লায় তোলা নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy