Advertisement
০৫ মে ২০২৪

কত তারাই তো দেখলাম, হাসছেন বাসুদেব

তিলবানি গ্রামের ঝিমধরা তপ্ত দুপুর। কাঁসার জামবাটি থেকে এক মুঠো মুড়ি মাখা মুখে ফেলে চিবোতে চিবোতে খানিকটা আনমনা সিপিএমের ন’বারের বর্ষীয়ান সাংসদ। “বহুদিন আগে ছাত্রাবস্থায় ‘সপ্তপদী’ দেখেছিলাম। সুচিত্রা সেনের মেয়ের সঙ্গে ভোটে লড়তে হবে ভাবিনি।” ডাকসাইটে বাম নেতা সুচিত্রা সেনের ফ্যান না কি?

বৃহস্পতিবার হিড়বাঁধে বাসুদেব আচারিয়া। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

বৃহস্পতিবার হিড়বাঁধে বাসুদেব আচারিয়া। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
হিড়বাঁধ শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৪৩
Share: Save:

তিলবানি গ্রামের ঝিমধরা তপ্ত দুপুর। কাঁসার জামবাটি থেকে এক মুঠো মুড়ি মাখা মুখে ফেলে চিবোতে চিবোতে খানিকটা আনমনা সিপিএমের ন’বারের বর্ষীয়ান সাংসদ।

“বহুদিন আগে ছাত্রাবস্থায় ‘সপ্তপদী’ দেখেছিলাম। সুচিত্রা সেনের মেয়ের সঙ্গে ভোটে লড়তে হবে ভাবিনি।” ডাকসাইটে বাম নেতা সুচিত্রা সেনের ফ্যান না কি? “ধুর্! জীবনে সিনেমাই দেখিনি তেমন আর।” তা হলে তারকা প্রতিপক্ষ কি আপনাকেও চিন্তায় ফেলে দিয়েছেন? ছোলা ভাজা মুখে ফেলতে ফেলতে খুক খুক করে হেসে ফেললেন বাসুদেব আচারিয়া। “কত তারাই তো দেখলাম। আমার রাজনীতির অভিজ্ঞতা ৪৬ বছরের। আর উনি (মুনমুন) সে দিন বললেন, ‘ওর অভিজ্ঞতা বলতে না কি ওর স্বামীর পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা!” তারপর আবার এক মুঠো মুড়ি মুখে দিলেন। “সুব্রত-র (মুখোপাধ্যায়) মতো পোড়খাওয়া নেতা গতবার এত সিরিয়াসলি লড়াইটা দিয়েও পারলেন না। কোনও তারকা তো ছার।”

সিপিএমের কর্মী-সমর্থকরা কিন্তু আড়ালে বলছেন, চাপ বিলক্ষণ বেশি এ বার। বাহাত্তরে পা দেওয়া বাসুদেববাবু তাই রোজ ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে পড়ছেন। প্রাতর্ভ্রমণ, প্রাণায়াম করে দই-চিঁড়ে ব্রেকফাস্ট। তারপরেই শুরু হচ্ছে দৌড়। তিনটি করে ইনসুলিন ইঞ্জেকশন নিয়ে দিনে অন্তত তিনটে গ্রামে সভা। আলিমুদ্দিনের নির্দেশ রোড-শো ফোড-শো নয়। গ্রামের ভিতর মানুষের মধ্যে গিয়ে ‘ইনটেনসিভ ক্যাম্পেন’ করতে হবে। মাঝে দুপুরে শুধু দু-তিন ঘণ্টার বিশ্রাম। বাসুদেববাবুর পায়ের পাতা ফুলে ঢোল। গলাটাও মাঝে মধ্যে ভোগাচ্ছে। তবুও বলছেন, “বয়স আর ডায়াবেটিস নিয়েও আমার ৩৬৫ দিন দিবা-রাত পরিশ্রমের ক্ষমতা আছে। তৃণমূলের নায়িকা প্রার্থীর কি তা আছে?” উনি কিন্তু প্রত্যেক মিটিংয়ে বলছেন, ন’বার সুযোগ পেয়েও বাসুদেববাবু বাঁকুড়ার মানুষের জন্য কিছুই করেননি। এতক্ষণ প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে খাটের উপরে বসেছিলেন। এ বার উঠে ধবধবে সাদা একটা শার্ট গলাতে গলাতে নিরুত্তাপ গলায় উত্তর দিলেন, “শুনেছি। তাই কয়েক দিনের মধ্যেই একটা ছাপানো কাজের খতিয়ান প্রকাশ করছি আমরা।”

নেতা যতই আত্মবিশ্বাসী থাকুক। সিপিএমের কর্মী-সমর্থকেরা কিন্তু এতেই নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। মুনমুন সেনের সভায় ভালই লোক হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে কিছু দিনের মধ্যেই মিঠুন, রাইমা, রিয়ার মতো নক্ষত্রেরা প্রচারে আসবেন। কোথাও একটা চিনচিনে অস্বস্তি কাজ করছে তাঁদের মধ্যে। কিন্তু নেতা সাদা শার্টের পকেটে ডটপেন লাগাতে লাগাতে ডাঁটের সঙ্গে বললেন, “লিখে নিন আমি জিতব, কনফিডেন্ট। গতবার সুব্রত খানিকটা ভোট কেটেছিল। এ বার তাও হবে না। সবাই তো সিনেমা স্টার দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন। এর মধ্যে কতজন ভোট দেয় দেখুন।” মুনমুন কিন্তু সব জায়গাতেই বলছেন, উনি এখানে কাজ করতে এসেছেন। এখানেই থাকবেন। সুখে-দুঃখে মানুষ তাঁকে পাবেন। বলছেন আপনি সাধারণ মানুষের থেকে দূরে সরে এসেছেন। এ বার একটা প্রাণখোলা হা হা হাসি ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। “উনি থাকবেন চার-পাঁচটা এসি বেডরুম নিয়ে। মানুষ সেখানে ঢুকতেই ভয় পাবেন। আর আমার বাড়িতে দরজায় কখনও ছিটকিনি দেওয়া থাকে না। সকাল ৮টা থেকে লোক আসা শুরু হয়, সেটা রঘুনাথপুরের বাড়ি হোক কিংবা দিল্লির অশোক রোডের বাংলো।”

একজন এসে তাড়া দিলেন। গাড়ি এসে গিয়েছে। বৃহস্পতিবারের তিন নম্বর গ্রামসভায় যেতে হবে হিড়বাঁধের দুঃসতিনিয়া গ্রাম। রবারের চপ্পল গলিয়ে গট্ গট্ করে হেঁটে গাড়িতে উঠলেন। গাড়ি চলল লালমাটির ধুলো উড়িয়ে। আর প্রার্থী নিজের থেকেই একের পর এক গল্প বলে যেতে লাগলেন। সংসদে গত দু’বছর তিনি বলতে উঠলেই নাকি তৃণমূলের সাংসদরা চিৎকার করে সভা ভন্ডুল করতে যান। একবার নাকি তেড়ে মারতেও এসেছিলেন। তাঁকে জানানো হল, মুনমুন সব সভাতেই বলছেন, জিতলে তিনি “নীরব প্রজাপতি হয়ে থাকবেন না। সংসদে টেবিল চাপড়ে হিন্দি-ইংরেজিতে বাঁকুড়ার মানুষের দাবি জানাবেন।” গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে সিপিএম প্রার্থীর প্রতিক্রিয়া, “ভাল। এমনিতেই তৃণমূলের একজোড়া তারকা সাংসদ রয়েছেন (তির শতাব্দী-তাপসের দিকে)।

তাঁদের পারফরম্যান্সের কথা নাই বা বললাম। তাতে আরও এক জন যুক্ত হতে চাইছেন।”

কথা শেষ হওয়ার আগেই ঢিম ঢিম ঢিম ঢিম মাদলের আওয়াজ। আদিবাসী গ্রামের মেঠো পথে সিপিএম প্রার্থীর একগাড়ির কনভয় থেমেছে। চারদিকে শাঁখ, উলু, গাঁদাফুলের পাপড়ি উড়ে আসছে। খানিকটা এগিয়ে বাঁ দিকে মাঠে ত্রিপল পাতা। সামনে কয়েকটা লাল প্লাস্টিকের চেয়ার। একটা মাইক। দর্শকাসনে বেশির ভাগই মহিলা আর শিশু। বাসুদেববাবু বক্তৃতা শুরু করলেন, অরণ্যের অধিকার থেকে শুরু করে কৃষকদের আত্মহত্যা, মূল্যবৃদ্ধি, চিটফান্ড কিছুই বাদ যাচ্ছে না। গলায় নাটকীয় ওঠানামা চলছে। শক্ত শক্ত শব্দচয়ন করছেন। দর্শক আসনের ৯০ শতাংশ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। পাশে বসা এক নেতাকে জিজ্ঞাসা করা গেল, “এত জটিল করে বলছেন, মানুষ বুঝতে পারছে তো?” তিনি একগাল হেসে বললেন, “ওঁর কথা তো লোকে শুনতেই চায়। আমরা বলি কম বলুন, কিন্তু লোকে বলে বেশি বলুন। আর যদি নাও বোঝে অসুবিধা নেই, ভোট আমাদেরই দেবে।”

ঝাড়া এক ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। অবশেষে সভা শেষ। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। চারপাঁচটা বাচ্চা ট্যাঁ-ট্যাঁ করে কান্না জুড়েছে। মেয়েরা ঘরমুখী। খানিকটা জল খেয়ে প্রার্থী হেসে বললেন, “কেমন লাগল?” একটু কঠিন হয়ে গেল না? “না তো, জলের মতো বুঝিয়ে বলেছি। তৃণমূল প্রার্থীর মতো বলিনি আমাকে ভোট দিন। বলেছি বামপন্থীদের হাত শক্তিশালী করুন। আমাদের স্টাইল আলাদা।” চারপাশে স্লোগান উঠল ইনক্লাব জিন্দাবাদ।

একটা তৃপ্তি ফুটে উঠল বাসুদেববাবুর চোখেমুখে। কিছুক্ষণ সেটা উপভোগ করলেন। তারপর বললেন, “একটা দুঃখ রয়ে গিয়েছে আমার। আমার বিপক্ষে একবার যে দাঁড়ায়, তাঁকে আর পরের বার আমি খুঁজে পাই না।”

“ফলে আলাপটা আর তেমন ভাবে জমে ওঠে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parijat hirbandh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE