Advertisement
১৮ মে ২০২৪

কবে মহকুমা হবে, অপেক্ষায় মানবাজার

তখনও ইংরেজরা এ দেশ জাঁকিয়ে রাজ্যপাট করে যাচ্ছে। বাংলার পশ্চিমাংশে মানভূম নামে এক জেলা গঠন করে জেলা সদর হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মানবাজারকে। একে একে জেলা সদরের সব প্রশাসনিক কাঠামো প্রশাসনিক ভবন, আদালত, জেলখানা, সেনাআবাস, ডাকঘর থেকে স্কুল তৈরি করেছিল ব্রিটিশ সরকার। বছর খানেক পরে অবশ্য নানা কারণে জেলার সদর মানবাজার থেকে পুরুলিয়ায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

বাসস্ট্যান্ডে ঢোকার মুখে বেহাল মানবাজার-বান্দোয়ান রাস্তা। ছবি তুলেছেন প্রদীপ মাহাতো।

বাসস্ট্যান্ডে ঢোকার মুখে বেহাল মানবাজার-বান্দোয়ান রাস্তা। ছবি তুলেছেন প্রদীপ মাহাতো।

সমীর দত্ত
শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৫৬
Share: Save:

তখনও ইংরেজরা এ দেশ জাঁকিয়ে রাজ্যপাট করে যাচ্ছে। বাংলার পশ্চিমাংশে মানভূম নামে এক জেলা গঠন করে জেলা সদর হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মানবাজারকে। একে একে জেলা সদরের সব প্রশাসনিক কাঠামো প্রশাসনিক ভবন, আদালত, জেলখানা, সেনাআবাস, ডাকঘর থেকে স্কুল তৈরি করেছিল ব্রিটিশ সরকার। বছর খানেক পরে অবশ্য নানা কারণে জেলার সদর মানবাজার থেকে পুরুলিয়ায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

দেশের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে না সরালে কলকাতা কি এমনই থাকত? এই প্রশ্নটার মতোই মানবাজারের বাসিন্দাদেরও আক্ষেপ, জেলা সদর সরিয়ে না নিয়ে গেলে মানবাজারও এমনটা থাকত না। পরিষেবার হয়তো অনেক উন্নতি হত। সামাজিক থেকে আর্থিক দিক দিয়েও উন্নয়ন ঘটত।

প্রায় ২০০ বছর আগে যে জায়গায় জেলা সদর ছিল, সেই মানবাজার এখনও মহকুমার স্বীকৃতি পায়নি। হয়নি পুরসভাও। আর পাঁচটা গ্রামীণ এলাকার মতোই পঞ্চায়েতের অধীনেই রয়ে গিয়েছে। ফলে জনবসতি বাড়লেও উন্নয়ন বিশেষ কিছু হয়নি। রাস্তাঘাট থেকে বাজার, নিকাশি থেকে পানীয় জল সবরকম নূন্যতম পরিষেবা নিয়েই ক্ষোভ রয়েছে বাসিন্দাদের মধ্যে। মানবাজারের মানভূম কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রধান প্রদীপ মণ্ডলের কথায়, “মানভূম জেলার বিস্তৃতি পূর্বে বাঁকুড়ার রাইপুর, পশ্চিমে বরাভূম রাজ্য, দক্ষিণে চান্ডিল এবং উত্তরে চাষ চন্দনকিয়ারি পর্যন্ত ছিল। মানবাজার বছর খানেক জেলা সদর হিসেবে ছিল।” তাঁর আক্ষেপ, মানবাজার পরবর্তীকালেও জেলা সদর থাকলে এখানকার ছবিটাই বদলে যেত।

মানবাজার পঞ্চায়েতের অধীনে ১৫টি গ্রাম সংসদ আছে। আশপাশের গ্রামাঞ্চল থেকে যেমন এখানে লোকজন উঠে আসছেন, তেমনই চাকরি বা ব্যবসা সূত্রেও অনেকে মানবাজারে স্থায়ী ঠাঁই নিয়েছেন। বসবাসকারীর সংখ্যাও বাড়ছে। চাকরির মেয়াদ শেষে অনেকে এখানকার স্থায়ী বাসিন্দাও হয়ে গিয়েছেন। প্রশাসন সূত্রে খবর, বর্তমানে মানবাজার শহরে কমবেশি ৩০ হাজার মানুষের বাস।

আড়েবহরে বাড়লেও পরিকল্পনা মাফিক ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট নির্মাণ না হওয়ায় এই শহরে যানজট নিত্যসঙ্গী। মানবাজারের চৌমাথায়, ব্যাঙ্ক মোড় এলাকায় ব্যস্তসময়ে প্রায়দিনই যানজট লেগে থাকে। একে শহরের রাস্তা প্রয়োজনের তুলনায় সরু। তার উপরে গাড়ির চাপ বাড়ছে। এর উপরে রাস্তার উপরেই যত্রতত্র রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি রাখা থাকে। গাড়ি থামিয়ে মালপত্রও ওঠানামা করানো হয়। ফলে যানজট পাকিয়েই থাকে। সেই জটে আটকে পথচারীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে।

এলাকার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, প্রায় দেড় দশক আগে শহরের যানজট এড়ানোর জন্য বাস ও ট্রাক বাইপাস হয়ে বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। কিন্তু নিয়ম থাকলেই মানছে কে! মানবাজারে আসলে নিয়ম না মানাটই নিয়ম। অধিকাংশ চালক নিষেধাজ্ঞা ভেঙে শহরের মধ্যে বড় গাড়ি ঢোকাচ্ছেন। যার জেরে যানজট আরও ভয়াবহ চেহারা নিচ্ছে। যানজটে আটকে বিশেষত স্কুলপড়ুয়ারা খুব ভুগছে।

পরিষেবা নিয়ে ক্ষোভ আরও রয়েছে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, পথবাতি থাকলেও শহরের সব রাস্তায় আলো জ্বলে না। এর ফলে সন্ধ্যা নামলেই শহরের কিছু রাস্তা অন্ধকারে ডুবে যায়। অনেকে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতে ভয় পান। তাঁদের দাবি, প্রশাসন একটি সজাগ থাকলেই খারাপ হয়ে যাওয়া আলো সারিয়ে দিতে পারত। অন্ধকারের জন্য অনেক সময় অপরাধমূলক ঘটনাও ঘটছে। রাস্তায় রাস্তায় পর্যাপ্ত আলো থাকলে অপরাধের সম্ভাবনাও কমে যাবে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় নিকাশি নালা রয়েছে বটে, তবে তার আউটলেট না থাকায় বর্জ্যসহ নোংরা জল উপচে গিয়ে রাস্তায় গড়ায়। বাসিন্দাদের অভিযোগ, নোংরা জল পায়ে মাড়িয়েই যাতায়াত করতে হচ্ছে। পরিকল্পনা করে নিকাশি নালা তৈরি করলে এই হয়রানির হাত থেকে তাঁরা মুক্তি পেতেন। কিন্তু পঞ্চায়েত এলাকায় রয়ে যাওয়ায় এই সামান্য উন্নয়নের কাজও এখানে হচ্ছে না।

মানবাজার ব্যবসায়ী সমিতির মুখপাত্র আনন্দময় সেন রাজনৈতিক সদিচ্ছার দিকেই আঙুল তুলেছেন। তাঁর ক্ষোভ, “শহরকে পরিচ্ছন্ন করা ও সাজিয়ে তোলার জন্য বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বর্তমান শাসক দলও একই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। মহকুমা সদর ও পুরসভা হলে এখানকার নাগরিক পরিষেবার মান বাড়বে।” মানবাজারের পঞ্চায়েত প্রধান তৃণমূলের বাসন্তী মুর্মু বলেন, “পঞ্চায়েতের হাতে সীমিত ক্ষমতা রয়েছে। নিয়মিত না হলেও নিকাশি নালা পরিষ্কার এবং রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করা হয়। টাকার টান থাকলে তখন আলো পাল্টাতে একটু দেরি হয়ে যায়।”

এতো গেল উন্নয়ন নিয়ে হতাশার কথা। মুহকুমা সদর না হওয়ায় পদে পদে দক্ষিণ পুরুলিয়ার তামাম এলাকার বাসিন্দাদের নিত্যনৈমিক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। পুরুলিয়া সদরের দূরত্ব মানবাজার থেকে ৫৪ কিলোমিটার। মানবাজার ২ ব্লকের সিন্দরাইডি গ্রামের সিন্ধুবালা মুর্মুর অভিজ্ঞতা, “মাসখানেক আগে নাতির সঙ্গে আমি পুরুলিয়ায় মহকুমাশাসকের অফিসে একটা কাজে গিয়েছিলাম। ওই অফিসের ১০ মিনিটেই কাজ হয়ে গেল। কিন্তু এতটা পথের বাস যাত্রার ধকল সামলে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। মানবাজারে ওই অফিস হলে আমাদের ভোগান্তি কত কমে যেত।”

২০০৯ সালে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঝালদা ও মানবাজারকে মহকুমাস্তরে উন্নীত করা হবে বলে ঘোষণা করেন। বাসিন্দাদের আক্ষেপ, তখন তাঁরা আশা করেছিলেন এ বার তাঁদের দুর্ভোগ কমবে। দেরিতে হলেও মানবাজার হয়তো হৃত গৌরব ফিরে পাবে। পাঁচ বছর গড়িয়ে গেলেও মহকুমা চালুর বিষয়টি এখনও অন্ধকারে। মানবাজারের বিধায়ক সন্ধ্যারানি টুডু বলেন, “মানবাজারে মহকুমার স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আগেও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। এখন বিষয়টি কোন পর্যায়ে আছে ফের তা জানতে চাইব।”

জেলা তৃণমূলের সভাপতি তথা স্বনির্ভর ও স্বনিযুক্তি দফতরের মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো বলেন, “মহকুমা অফিসের জন্য মানবাজারের জায়গা চিহ্নিত হয়ে গিয়েছে। ঝালদাতেও জমি দেখার কাজ চলছে। তবে মহকুমা চালু করার ব্যাপারে আগে উচ্চ আদালতের অনুমতি পাওয়া দরকার। আদালতের অনুমতি পাওয়া গিয়েছে কি না খোঁজ নিয়ে দেখব।”

প্রশাসনিক স্তরে খোঁজ নিতে গিয়েও মহকুমার বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। কখনও শোনা যায়, ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের নতুন ভবনে মহকুমা অফিস চালু করা হবে বলে স্থির হয়েছে। আবার কখনও শোনা যায়, বিসরি অঞ্চলের দোলদেড়িয়া গ্রামের কাছে একলপ্তে অনেকখানি খাস জায়গার সন্ধান মিলেছে অফিস তৈরির জন্য। কিন্তু কোনটাই সরকারি স্তরে স্বীকার করা হয় না। সরকারি আধিকারিকরাও ধোঁয়াশার মধ্যে আছেন। মহকুমাশাসক (পুরুলিয়া সদর) সৌম্যজিৎ দেবনাথ বলেন, “কবে মানবাজার মহকুমা হবে, আমার জানা নেই।” মানবাজারের বিডিও সায়ক দেব জানান, মহকুমা চালুর জন্য ভবন অথবা ভবন নির্মাণের জন্য জায়গা বাছাই কোনওটাই এখনও ঠিক হয়নি। এ নিয়ে কোনও নির্দেশও আসেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar shohor manbazar samir dutta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE