Advertisement
০১ মে ২০২৪

গ্রামে শান্তি ফেরাতে মদ বন্ধে এককাট্টা কুলিয়াড়া

কারও বাপ-ঠাকুর্দা মদ বিক্রি করতেন, কারও কাকা-জ্যাঠা সেই মদ খেতেন। আর দু’পক্ষই বচসায় জড়িয়ে পাড়া মাথায় করে তুলতেন! পরিবার তো বটেই, মদ্যপদের উপদ্রবে অতিষ্ট ছিল গোটা গ্রাম। শিকেয় উঠত ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও। কিন্তু কেউ মাতালদের ঘাঁটাতে সাহস পেতেন না। এতদিন তাঁরা বিনা বাধ্যায় এলাকা দাপিয়ে বেড়াত।

গ্রামে ক্লাবের সদস্যদের মাদক বিরোধী অভিযান। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

গ্রামে ক্লাবের সদস্যদের মাদক বিরোধী অভিযান। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

অর্ঘ্য ঘোষ
ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৪ ০১:১৪
Share: Save:

কারও বাপ-ঠাকুর্দা মদ বিক্রি করতেন, কারও কাকা-জ্যাঠা সেই মদ খেতেন। আর দু’পক্ষই বচসায় জড়িয়ে পাড়া মাথায় করে তুলতেন!

পরিবার তো বটেই, মদ্যপদের উপদ্রবে অতিষ্ট ছিল গোটা গ্রাম। শিকেয় উঠত ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও। কিন্তু কেউ মাতালদের ঘাঁটাতে সাহস পেতেন না। এতদিন তাঁরা বিনা বাধ্যায় এলাকা দাপিয়ে বেড়াত। সম্প্রতি দীর্ঘ দিনের চেনা এই ছবিটাই পাল্টে দিয়েছেন গ্রামেরই একটি ক্লাব। জনা কয়েক সদস্য এককাট্টা হয়ে রুখে দিয়েছেন এলাকার বেআইনি মদের রমরমা কারবার।

সামাজিক উত্তরণের ঘটনাটি ঘটেছে ময়ূরেশ্বরের কুলিয়াড়া বায়েন পাড়ায়। ১৩৫টি পরিবারের বাস ওই পাড়ার অধিকাংশই পেশায় খেতমজুর। যৎসামান্য জমি রয়েছে মুষ্টিমেয় কয়েক জনের। ৪৫টি পরিবারের সহায়ক পেশা ঢাক বাজানো। বেশিরভাগ পরিবারেই নুন আনতে পান্তা ফুরানোর হাল। ওই দুরবস্থার জন্য পুরুষানুক্রমিক মদের নেশাই দায়ী বলে গ্রামবাসীদের দাবি। তাঁরা জানান, একসময় ওই গ্রামের বেশ কিছু পরিবার বেআইনি চোলাই মদ তৈরি করে বিক্রি করতেন। আর বাকিরা স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের অভুক্ত রেখে রোজগারের সমস্ত টাকা মদ খেয়ে ওড়াতেন। মদ্যপ অবস্থায় পাড়ার শান্তি নষ্ট করতে করতে বাড়ি ফিরে অভুক্ত স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের পেটাতেনও। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া কিছুই হত না। পেটের খাতিরে স্কুল ছেড়ে পরের বাড়িতে কাজ নিতে হত। সুদীপ দাস, রাজু দাসরা বলেন, “শুধু পরিবারের লোকেরাই নন, সন্ধ্যা নামলেই মদ খেতে বহিরাগত বহু দুষ্কৃতীও এলাকায় ঝামেলা পাকাত। প্রতিদিন গ্রামে নানা অসামাজিক কাজও করত। এরফলে স্বাভাবিক পরিবেশটাই নষ্ট হয়ে যেত। প্রতিটি পরিবারে অশান্তি লেগেই থাকত। যার বিরূপ প্রভাব পড়ত ছেলেমেয়েদের উপরেও।”

এলাকায় অশান্তির কারণে গ্রামের অনেককে মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিতে হয়েছে। বাসিন্দারা জানান, তাঁরা ঠিক করেন, পরবর্তী প্রজন্মের লেখাপড়া নিশ্চিত করতে সর্বাগ্রে গ্রাম থেকে মদ হঠাতে হবে। সেইমতো গ্রামের ‘যুব সঙ্ঘ ক্লাবে’ বৈঠকে বসেন সদস্যেরা। গ্রামবাসীরাও সামিল হন। বৈঠকে স্থির হয় গ্রামে যাঁরা মদ তৈরির সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বুঝিয়ে ওই ব্যবসা থেকে সরে আসার জন্য অনুরোধ করা হবে।

ক্লাবের সভাপতি গুরুপদ দাস বলেন, “ওই অনুরোধ নিয়ে মদ বিক্রেতাদের কাছে যেতেই প্রথমে আমাদের হোঁচট খেতে হয়। মদ বিক্রেতারা সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন, ব্যবসা তুলে দিলে খাব কী? তখন আমরা তাঁদের জানাই, গ্রামের অল্প সংখ্যক মানুষ মদের ব্যবসা করেন বাকিরা তো বিভিন্ন রকম কাজ করে পেটের ভাত জোগাড় করেন। আপনারাও বিকল্প জীবিকা খুঁজে নিন। প্রয়োজনে ক্লাব আপনাদের পাশে দাঁড়াবে।” মদ বিক্রেতাদের ওইভাবে নিরস্ত করা গেলেও দীর্ঘদিন ধরে যারা নিয়মিত মদ খেতে অভ্যস্ত তাদের কিন্তু অত সহজে বাগে আনা সম্ভব হয়নি। ক্লাবের সম্পাদক নিতাই দাস বলেন, “আমাদের গ্রামে মদ বিক্রি বন্ধ হলেও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে দেদার মদ বিক্রি হয়। স্থানীয় বাজারেও বিদেশি মদ পাওয়া যায়। তা ছাড়া মদ খাওয়াটা নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার তাই আমরা ওইসব মদ্যাসক্তদের বলি, তোমরা মদ ছাড়তে না পার, তা হলে মাতাল অবস্থায় গ্রামে ঢুকে শান্তি নষ্ট করা যাবে না। যতক্ষণ নেশা না ছোটে, ততক্ষণ গ্রামের বাইরে কাটাতে হবে। তারপর বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। না হলে শান্তিভঙ্গের অভিযোগে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে।”

ওই ওষুধেই কাজ হয়।

একাদশ শ্রেণির ছাত্রী সুদীপা দাস, বিএ দ্বিতীয় বর্ষের শর্মিলা দাসরা বলেন, “এক সময় মাতালদের চিৎকারে পড়ায় মন বসাতে পারতাম না। এখন আর সেই ঝামেলা নেই।” গ্রামের বাসিন্দা তথা স্থানীয় ঢেকা পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের মিঠু গড়াই এবং সংশ্লিষ্ট ময়ূরেশ্বর ২ নং পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কল্যাণী দাস বলেন, “ক্লাবের ছেলেরা যে ভাবে মদ বন্ধ করে গ্রামে শান্তি ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছে, তা অনুসরণযোগ্য। প্রয়োজনে আমরাও ওই উদ্যোগে সামিল হব।” গ্রামবাসীদের এমন উদ্যোগের কথা শুনে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ময়ূরেশ্বর ২ নং ব্লকের বিডিও সৈয়দ মাসুদুর রহমান। তিনি বলেন, “ওই ক্লাবের সদস্যদের মতো অন্যরাও যদি নিজেদের গ্রামের পরিবেশের সুস্থতা রক্ষায় সচেষ্ট হন, তা হলে সমাজটা আরও সুন্দর হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

argha ghosh mayureswar anti liquor movement
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE