Advertisement
০৫ মে ২০২৪

জল ভরতে হাতাহাতিই রোজনামচা

দিব্যি লাইন ধরে সবাই জল ভরছিলেন। হঠাৎ ট্যাপকলের জলের গতি কমে গিয়ে একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। খালি বালতি, হাঁড়ি নিয়ে বাসিন্দারা ঘরে ফিরে গেলেন। মিনিট কুড়ি পরে ট্যাপকলে ফের জল পড়া শুরু হল। খবর পেতেই হইহই করে পাড়া ভেঙে লোকজন জল নিতে ছুটে এলেন। কে আগে নেবেন, তা নিয়ে তুমুল হট্টগোল থেকে হাতাহাতি পর্যন্ত বেধে গেল। পাড়া ছাড়িয়ে গোলমালের জের গড়াল থানা অবধি। বরাবাজারের বাজার এলাকার এই ছবি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মাঝে মধ্যেই জল নিয়ে গোলমাল হচ্ছে।

যখন তখন কলের জল বন্ধ হয়ে যায়। তাই বালতি নিয়ে এ ভাবেই চলে অপেক্ষা। ছবি: প্রদীপ মাহাতো

যখন তখন কলের জল বন্ধ হয়ে যায়। তাই বালতি নিয়ে এ ভাবেই চলে অপেক্ষা। ছবি: প্রদীপ মাহাতো

সমীর দত্ত
বরাবাজার শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৫০
Share: Save:

দিব্যি লাইন ধরে সবাই জল ভরছিলেন। হঠাৎ ট্যাপকলের জলের গতি কমে গিয়ে একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। খালি বালতি, হাঁড়ি নিয়ে বাসিন্দারা ঘরে ফিরে গেলেন।

মিনিট কুড়ি পরে ট্যাপকলে ফের জল পড়া শুরু হল। খবর পেতেই হইহই করে পাড়া ভেঙে লোকজন জল নিতে ছুটে এলেন। কে আগে নেবেন, তা নিয়ে তুমুল হট্টগোল থেকে হাতাহাতি পর্যন্ত বেধে গেল। পাড়া ছাড়িয়ে গোলমালের জের গড়াল থানা অবধি। বরাবাজারের বাজার এলাকার এই ছবি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মাঝে মধ্যেই জল নিয়ে গোলমাল হচ্ছে।

বরাবাজারের রাজাপাড়ার বাসিন্দা প্রতিমা সিংহ, বেলারানি সিংহরা বলেন, “বাড়িতে কুয়ো রয়েছে। কিন্তু ওই জল খাওয়া যায় না। ওই জেল কাপড়কাচা হয়। কিন্তু খাওয়ার জন্য এই ট্যাপকলের জলই ভরসা। কিন্তু তা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায় না। এই সমস্যা কবে মিটবে কে জানে!” বরাবাজার ব্লকে ১০টি পঞ্চায়েত। তার মধ্যে বরাবাজার পঞ্চায়েতের শুধুমাত্র বাজার এলাকায় পাইপলাইনের জল রয়েছে। এ ছাড়া ভাগাবাঁধ পঞ্চায়েতের চন্দনপুর গ্রামে সজলধারা প্রকল্পে ১০০টি পরিবার পানীয় জলের সুবিধা পান। এ ছাড়া বাকি পঞ্চায়েতগুলিতে বাসিন্দাদের পানীয় জলের ভরসা সেই নলকূপ ও কুয়ো।

বরাবাজারের বিডিও অনিমেষকান্তি মান্না বলেন, “সম্প্রতি পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ থেকে জল প্রকল্পে ভাগাবাঁধ পঞ্চায়েতের জন্য ১৭ লক্ষ এবং বেড়াদা পঞ্চায়েতের জন্য ১৬ লক্ষ টাকা মিলেছে। কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। সিন্দরি পঞ্চায়েতেও এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। প্রকল্পগুলি চালু হয়ে গেলে প্রায় ৫০০ পরিবার পরিশ্রুত জল পাবেন।” তিনি জানান, ওই সব এলাকার উপভোক্তাদের নিয়ে সমিতি গড়ে দেওয়া হবে। তাঁরাই খরচ ও দেখভাল করবেন।

বরাবাজার বাজার এলাকায় অবশ্য দীর্ঘদিন আগে থেকেই জল সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে অভিযোগ বিস্তর। জল সরবরাহ নিয়মিত নয়। তার উপরে জলের বেগও ভালো নয় বলে অভিযোগ। এমন কেন হয়? জেলার জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় চার দশক আগে বরাবাজারে জল সরবরাহ প্রকল্প শুরু হয়েছিল। বরাবাজার বাজার থেকে ১ কিলোমিটার দূরে নেংসাই নদীর বোস্টমডির ঘাট থেকে পাম্পের সাহায্যে জল তোলা হয়। বরাবাজারের উপরপাড়ায় রিজার্ভার থেকে পাইপের সাহায্যে ওই জল সরবরাহ করা হয়। জল সরবরাহ প্রকল্পে পাম্প অপারেটারের দায়িত্বে থাকা নৃপেন দেওঘরিয়া বলেন, “আমি প্রায় তিন দশক ধরে এখানে কাজ করছি। ১৯৭২ সাল থেকে চালু হওয়া প্রকল্প থেকে জল সরবরাহের জন্য প্রথমে পয়েন্ট ছিল মাত্র ৫০টি, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১৩০টি। কেবলমাত্র বরাবাজার বাজার এলাকায় জল সরবরাহ করা হয়। রিজার্ভারের জলধারণ ক্ষমতা ২০ হাজার গ্যালন। কিন্তু এলাকায় লোকসংখ্যা এই ক’দশকে কয়েকগুণ বেড়েছে। সে তুলনায় জল সরবরাহের পরিকাঠামোগত উন্নতি হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই জলের গতি ও জল দেওয়ার সময় দুই কমেছে।”

বর্তমানে বরাবাজার ব্লকের জনসংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৭৫ হাজার। তার মধ্যে এই বাজার এলাকায় কমবেশি ১৫ হাজার লোকের বাস। বরবাজারের বাজার এলাকা ছাড়া অন্যত্র জল সরবরাহ শুরু করা যাচ্ছে না কেন? জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের কর্মীরা জানাচ্ছেন, নামে নদী হলেও আদতে নেংসাই একটি বড় খাল। নদীতে বালির পরিমাণ কম, তুলনায় পাথর বেশি। বর্ষায় নেংসাইয়ের দুকূল ছাপিয়ে জল বয়ে গেলেও বছরের বাকি সময়ে শুকিয়ে থাকে। দফতরের কর্মীদের একাংশের মতে, নদীতে বালি থাকলে জলধারণ ক্ষমতা বাড়ে। কিন্তু নেংসাই নদীতে বালি নেই। ফলে উপরের স্তরে জল তেমন থাকে না।

ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন করে সরবরাহ করা হয়। তাই জলের ভাণ্ডার ততটা শক্তিশালী না হওয়ায় জলও বেশি মিলছে না। জল সরবরাহ অনিয়মিত হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে কর্মীদের ব্যাখ্যা, লোডশেডিং থাকলে পাম্প চালানো যায় না। তাই জলসরবরাহ কখনওসখনও অমিয়মিত হয়ে পড়ে।

জলের গতি কম-বেশি নিয়েও কম ক্ষোভ নেই বাসিন্দাদের। কর্মীদের দাবি, পাইপ পাতার সময় সর্বত্র একই গভীরতা বজায় রাখা হয়নি। যার জেরে কোথাও দু’ফুট মাটির নীচে কোথাও বা চার ফুট মাটির তলা দিয়ে পাইপ গিয়েছে। ফলে জলের গতি সব জায়গায় সমান নয়। এখন সব পাইপ তুলে ঢাল বজায় রেখে নতুন করে পাইপ বসানোর খরচ বিস্তর। ফলে জলের গতি বৃদ্ধি কবে হবে সে ব্যাপারে তাঁরা কিছু জানাতে পারেননি।

এ দিকে রিজার্ভারটিও জীর্ণ হয়ে পড়েছে। রিজার্ভারের স্তম্ভে অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। কয়েকটি জায়গায় লোহার রডও বেরিয়ে গিয়েছে। বাসিন্দাদের আশঙ্কা, শুধু সংস্কার করে ওই রিজার্ভার বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যাবে না। তাঁরা নতুন একটি রিজার্ভার তৈরির দাবি তুলেছেন। বিডিওর আশ্বাস, বরাবাজার বাজারের জন্য আরও একটি জল প্রকল্পের প্রস্তাব জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের মন্ত্রীকে দেওয়া হয়েছে।

বরাবাজারের বাসিন্দা তথা জেলা পরিষদ সদস্য সুমিতা সিংহমল্ল বলেন, “বরাবাজার-মানবাজার রাস্তায় বাল্লার ঘাটে অথবা বরাবাজার-পুরুলিয়া রাস্তায় শাঁখারি মোড়ের কাছে আরও একটি জল প্রকল্প গড়ার জন্য মন্ত্রীকে প্রস্তাব দিয়েছি। ওই প্রকল্প তৈরি হলে বরাবাজারে জলের সঙ্কট অনেকটাই মিটে যাবে।”

যদিও জেলার গ্রামীণ জল সরবরাহের দায়িত্বে থাকা এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার সনৎ অধিকারী বলেন, “নতুন জল প্রকল্পের কথা আমার জানা নেই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

barabazar amar shohor amar sohor samir datta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE