Advertisement
০৫ মে ২০২৪

জল-সঙ্কট ঘোচেনি, উত্তাপ বাড়ছে সিউড়িতে

লোকসভা ভোটের মুখে জলপ্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়েছিল ঘটা করে। জল নিয়ে শহরবাসীর এ বার সমস্যা মিটে যাবে বলেই সে দিন দাবি করেছিল তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ড। কিন্তু অভিযোগ, উদ্বোধনের পরে পাঁচ মাস কেটে গেলেও জল-সঙ্কট মিটছে না সিউড়ি শহরের।

জলের জন্য অপেক্ষা করছেন সিউড়ির ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের রামকৃষ্ণপল্লির বাসিন্দা বীনা বিবি, হাসিনা বিবিরা।

জলের জন্য অপেক্ষা করছেন সিউড়ির ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের রামকৃষ্ণপল্লির বাসিন্দা বীনা বিবি, হাসিনা বিবিরা।

ভাস্করজ্যোতি মজুমদার
সিউড়ি শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৪ ০১:০৭
Share: Save:

লোকসভা ভোটের মুখে জলপ্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়েছিল ঘটা করে। জল নিয়ে শহরবাসীর এ বার সমস্যা মিটে যাবে বলেই সে দিন দাবি করেছিল তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ড। কিন্তু অভিযোগ, উদ্বোধনের পরে পাঁচ মাস কেটে গেলেও জল-সঙ্কট মিটছে না সিউড়ি শহরের। আবার এ নিয়ে এখনই কোনও আশার বাণী শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না পুরপ্রধানের মুখ থেকেও।

পুর প্রশাসন সূত্রে খবর, ষাটের দশকে ৫০ হাজার গ্যালনের একটি জলাধার দিয়ে সিউড়ি পুর এলাকার প্রথম জলপ্রকল্পটি চালু হয়েছিল। তার ৩৫ বছর পরে ১৯৯৫ সালে ৭০ হাজার গ্যালনের আরও একটি জলাধার চালু হয়। কিন্তু কোনওটিই শহরবাসীর চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট ছিল না। শেষমেশ ২০০২ সালে পিএইচই-র থেকে জল সরবরাহের দায়িত্ব নিয়ে নেয় পুরকর্তৃপক্ষ। বাসিন্দাদের আশা ছিল, এ বার বুঝি সমস্যা মিটল। কিন্তু জল সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই রয়ে যায়। তাই ২০০৭ সালে তত্‌কালীন বামফ্রন্ট সরকারের আমলে যখন ১০ কোটি টাকার জলপ্রকল্প অনুমোদন পেল, তখন সিউড়ির মানুষ নতুন করে আশা করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু ঘটনা হল, সেই জলপ্রকল্প উদ্বোধন হয়ে গেলেও সিউড়ি শহরের পানীয় জল নিয়ে সমস্যা মেটেনি। উল্টে প্রকল্পের টাকা খরচ নিয়ে বেনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগে পুরপ্রধানকে বিদ্ধ করেছেন দলেরই কাউন্সিলরদের একাংশ। তাঁদের মতামত ছিল, প্রকল্পের কাজ শেষ না করে এ ভাবে উদ্বোধন করা ঠিক হবে না। অবশ্য সেই বিরোধিতা অগ্রাহ্য করেই জলপ্রকল্পের উদ্বোধন হয়ে গিয়েছিল।

সিউড়িবাসী এখন কী বলছেন?

শহরের একটা বড় অংশেরই মোহভঙ্গ হয়েছে এই জলপ্রকল্প নিয়ে। কারণ হিসেবে তাঁদের যুক্তি, ওই প্রকল্পের উদ্বোধনের পরেও সমস্যার সুরাহা হয়নি। শহরের ১৮টি ওয়ার্ডের প্রায় সব ক’টিতেই পানীয় জল নিয়ে মানুষকে নিত্যদিন দুর্ভোগের মুখে পড়তে হচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় জলের জোগান অনেকটাই কম। সমস্যা আরও তীব্র শহরের ৩, ৫, ১৭ ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে। ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে রেল লাইনের অন্য পারের অংশটিতে এখনও জলের পাইপ লাইনই বসেনি। ২ নম্বর ওয়ার্ডের অরুণ মণ্ডল, ইন্দ্রাণী বসাকরা বলছেন, “এত কোটি টাকা ব্যয়ে জলপ্রকল্প হওয়ায় আমরা ভেবেছিলাম এ বার সুদিন দেখব। আর যাই হোক, জলের সমস্যা আর থাকবে না। কিন্তু সমস্যা মিটল কই!” এই গরমে জল নিয়ে সিউড়ির পুরনো সঙ্কট আরও তীব্র হয়েছে। এখন ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী বিশ্বনাথ ঘোষ, ১ নম্বর ওয়ার্ডের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শ্রীনিবাস আচার্য, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সীমা বিবিদের উপলব্ধি, “কিছু কাউন্সিলর যখন জলপ্রকল্পের উদ্বোধনে আপত্তি করেছিলেন, তখন ওঁদের উপরেই বিরক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু, এখন বুঝছি ওঁদের আপত্তির যথেষ্ট যুক্তি ছিল। কাজ শেষ হওয়ার আগেই উদ্বোধন করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সত্যি বলতে, জলের সমস্যা ঘোচেনি।” সেই সমস্যা কবে ঘুচবে বা আদৌ ঘুচবে কিনা, তা নিয়েও সন্দিহান তাঁরা।

ঘটা করে উদ্বোধনের পরেও এখনও চালু হয়নি
সিউড়ির চাঁদমারি মাঠে নবনির্মিত জলের ট্যাঙ্ক।

ওই ‘বিদ্রোহী’দের নেতা, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর দীপক দাস জানান, পুরসভা একটি নতুন জলাধার ব্যবহার করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সঠিক পরিকাঠামোর অভাবে তা হচ্ছে না। জলাধার থেকে পাইপ লাইনে জল ছাড়া মাত্র পুরনো পাইপ লাইন মাঝে মধ্যেই ফেটে যাচ্ছে। তাঁর দাবি, “মাত্র ৪ কিলোমিটার মতো নতুন পাইপ বসানো হয়েছে। তাও পুরনো পাইপ লাইনের সঙ্গে জোড়া হয়নি। আগে ৩৮ কিলোমিটার মতো পাইপ লাইন ছিল। নতুন প্রকল্পে ৫২ কিলোমিটার মতো পাইপ লাইন বসানোর কথা। যার মধ্যে অন্তত ৩০-৩২ কিলোমিটার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোনওটাই এখনও ঠিক ভাবে করা হয়নি।” তাঁর আরও দাবি, কেন্দ্র সরকারের তথ্য অনুযায়ী সিউড়ি শহরে প্রতিদিন ২০ লক্ষ গ্যালন জলের প্রয়োজন। কিন্তু নতুন জলপ্রকল্প চালু হওয়ার পরে জল দেওয়া হয় মাত্র ৭ লক্ষ গ্যালন। ফলে সমস্যা না মেটারই কথা।

এক দিকে, মানুষের সমস্যা মেটেনি, উল্টো দিকে, এই প্রসঙ্গেই উঠে আসছে ওই জলপ্রকল্প নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগও। পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে টাকা তছরুপের অভিযোগ করে হিসেব চেয়ে গত ১৬-২৪ ডিসেম্বর পুর চত্বরেই অনশনে বসেন তৃণমূল-কংগ্রেস মিলিয়ে সাত কাউন্সিলর। ওই আন্দোলনের নেতা দীপকবাবু জানান, জলপ্রকল্পের বরাদ্দ বেড়ে বর্তমানে ১৪.৪৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। পুরসভা এ পর্যন্ত ১২.২৮ কোটি টাকা পেয়েছে। পুর কর্তৃপক্ষ ৬.৭৩ কোটি টাকা খরচের ইউসি (ইউটিলাইজেসন সার্টিফিকেট) জমা দিয়েছে। তাঁর দাবি, “ওই প্রকল্পের ব্যাঙ্ক আ্যকাউন্টে কোনও টাকা নেই। বাকি টাকার তা হলে কি হল?” তাঁদের আপত্তি আগ্রাহ্য করে প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ না করেই শহরবাসীকে ভাওতা দিয়ে পুরসভা তড়িঘড়ি জলপ্রকল্পের উদ্বোধন করে দেয় বলে তাঁর অভিযোগ। প্রাক্তন পুরপ্রধান তপন শুকুলের আবার দাবি, তাঁর আমলে পুরসভা ওই প্রকল্পের জন্য ৪ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা পেয়েছিল। তা থেকে নতুন পাইপ কেনা, আটটি পাম্প বসানো, দু’টি ওভারহেড এবং একটি ভূগর্ভস্থ জলাধার তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান বোর্ড হাতে ৭ কোটি ৬৩ লক্ষ টাকা পেয়েও মানুষের জল-সঙ্কট মেটানোর জন্য কার্যত কিছুই করেনি। এমনকী, পুরপ্রধান কোন খাতে প্রকল্পের কত টাকা খরচ করেছেন, সেই হিসেবও তাঁদের দাবি মতো জনসমক্ষে জানাতে পারেননি।

সহকর্মীদের এই তোপের মুখে দাঁড়িয়ে তৃণমূল পুরপ্রধান উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়ের পাল্টা অভিযোগ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই কিছু কাউন্সিলর জলপ্রকল্প নিয়ে নানা ভাবে বিরোধিতা করার চেষ্টা করছেন। উদ্বোধনের সময় এমনটা না জানালেও এখন তাঁর বক্তব্য, “ওই প্রকল্প উদ্বোধন হলে যে জল সমস্যা ঘুচে যাবার নয়, তা সকলেরই জানা।” প্রকল্পের কাজ যে এখনও সম্পূর্ণ হয়নি সে কথাও তিনি মেনে নিয়েছেন। কিছু প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণেই কাজ শেষ হতে দেরি হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই কিছু পরিষেবা দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। নতুন পাইপ কেনার জন্য শীঘ্রই ই-টেন্ডারও ডাকা হবে। চাঁদমারি মাঠের জলাধার দু’টিও তাড়াতাড়ি চালু হয়ে যাবে। প্রকল্পের কিছু টাকা অন্য খাতে জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের কথা স্বীকার করলেও তিনি দুর্নীতির সব অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট দফতরকে নিয়মিত ঠিক ভাবেই হিসেব দেওয়া হয়।

এত কিছুর পরেও বাসিন্দাদের এই মুহূর্তেই খুশি হওয়ার কোনও কারণ দেখা যাচ্ছে না। কারণ উজ্জ্বলবাবুর বক্তব্য, “এই জলপ্রকল্পের কাজ শেষ হলেও সিউড়ির জল সমস্যা পুরোপুরি মিটবে না। এই প্রকল্পের বাইরেও অন্তত আরও চারটি জলাধার ও নতুন জলের উত্‌স প্রয়োজন।” এ ব্যাপারে তিনি রাজ্যের পুরমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন। তাঁর দাবি, পুরমন্ত্রী এ নিয়ে প্রয়োজনীয় আশ্বাসও দিয়েছেন।

ছবি দু’টি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

water crisis bhaskarjyoti majumdar suri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE