ভাঁড়কাটা ও হিংলো পঞ্চায়েতের অধিকাংশ গ্রাম আদিবাসী অধ্যুষিত। এলাকার সার্বিক উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে আদিবাসীদের সংগঠনগুলি নানা দাবি জানিয়ে আসছিল। যার অন্যতম ছিল পরিস্রুত পানীয় জল। ২০০২-’০৩ অর্থবর্ষে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার পিএমজিওয়াই (প্রধানমন্ত্রী গ্রামোদ্যোগ যোজনা) প্রকল্পে এলাকার জন্য ৩৮৫ কোটি টাকার জলপ্রকল্পের কথা ঘোষণা করে। ওই বছরই ভাঁড়কাটা পঞ্চায়েতের হাটগাছায় ‘হাটগাছা জল সরবরাহ প্রকল্প’-এর উদ্বোধন করেন তৎকালীন জনস্বাস্থ্য কারিগরী দফতরের মন্ত্রী গৌতম দেব। পরিকল্পনা ছিল হিংলোর ফুলপাহাড়ি গ্রাম লাগোয়া দাঁড়কা নদীতে পাম্প বসানো। সেখান থেকে পাইপ লাইনে আধ কিলোমিটার দূরের ফুলপাহাড়িতে জল নিয়ে এসে, সেখানেই তা পরিস্রুত করা। তারপর হাটগাছায় নির্মিত ৬০ হাজার গ্যালনের উচ্চ জলাধারে পাঠানো। সেই জলাধার থেকে পাইপ লাইন মাধ্যমে ২৫টি গ্রামের ৩৪টি পাড়ায় জল পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। অভিযোগ, কাজ সম্পূর্ণ না হলেও বছর তিনেকের মধ্যে ওই জলপ্রকল্প চালু করে দেওয়া হয়। ফলে মূল লক্ষ্যই পূরণ হয়নি।
জনস্বাস্থ্য কারিগরী দফতরের উদ্যোগে ২০০৫ সালের ১ জুন থেকে জল দেওয়া শুরু হয়। ভাঁড়কাটার শালডাঙা, জেটকেপাড়া, খোটেপাড়া-সহ ৩৪টি স্থানে ট্যাপকল বাসানো হয়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় কলের সংখ্যা ছিল একেবারেই কম। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, দিনে মাত্র একবারই জল মিলত। সকাল ছ’টা থেকে সাড়ে ছ’টার মধ্যে জল পড়তে শুরু হওয়ার পরে মাত্র ২০-২৫ মিনিট জল পাওয়া যেত। বহু জায়গায় ওটুকু সময়ও বরাদ্দ হত না। আবার সাগরবাঁধি গ্রামের মতোও কিছু অঞ্চল আছে, যেখানে কোনও দিনই জল পৌঁছয়নি।
গাঁওতার তরফে প্রকল্প দেখাশোনা করতেন হাবড়াপাহাড়ির সুকুমার সাহা। তাঁর কথায়, “প্রকল্প শুরুর প্রথম থেকেই সাগরবাঁধি-সহ তিন চারটি গ্রামে কোনও দিনই জল পৌঁছয়নি। আর চালু হওয়ার দু’চার মাস পর থেকে তো জলপ্রকল্প একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। অধিকাংশ গ্রামের মানুষই জল পান না।” হাবড়াপাহাড়ি, হরিণসিঙ্গা ও বারমেসিয়ার পঞ্চায়েত সদস্য যথাক্রমে কার্তিক টুডু, সোমচাঁদ হেমব্রম ও মানি হেমব্রমদের ক্ষোভ, “এই এলাকায় যা কিছু হয় সবই ভোটকে কেন্দ্র করে। ২০০৬ সালে বিধানসভা ভোট ছিল। পুরো কাজ শেষ না হতেই জলপ্রকল্প উদ্বোধন করে দেওয়া হয়।” জেটকে পাড়ার যদু হাঁসদা, খোটে পাড়ার লোলিন সোরেন, ঢোলকাটার সোনা টুডু, সোনাগড়িয়ার তালপা হাঁসদা, বাথানের দরতি হেমব্রম, গিড়িজোড়ের মঙ্গল হেমব্রম, লক্ষ্মীটুডুরা বলছেন, “সবই আসলে লোক দেখানো। প্রকল্পের কলে এক দিন জল আসে তো পাঁচ দিন আসে না। যে দিন আসে, সে দিন ১৫-২০ মিনিটের বেশি জল পড়ে না। কেউ পায়, কেউ পায় না।”
সুকুমারবাবু জানান, সামগ্রিক ভাবে এই বিশাল এলাকার জন্য ওই জলপ্রকল্পটি কোনও দিনই যথেষ্ট ছিল না। তার উপর মাঝে বিল বকেয়া থাকায় বিদ্যুৎ দফতর জলপ্রকল্পের সংযোগই কেটে দিয়েছিল। ফলে যেটুকু জল মিলত, তা-ও ব্যাহত হয়েছিল। তাঁর দাবি, বর্তমান সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরির উদ্যোগে বিদ্যুৎ সংযোগ ফেরে। দু’টি ঠিকিদার সংস্থাকে প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্বও দেওয়া হয়। পিএইচই-র এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার অর্ধেন্দু দত্ত জানান, ২০০৬-’০৭ পর্যন্ত সুষ্ঠু ভাবে কাজও চলে। পরিষেবা উন্নয়নের জন্য ২০০৯-’১০ সালে আরও ১১৫ কোটি মিলেছিল। ফলে প্রকল্পটির মোট খরচ দাঁঁড়ায় ৫০০ কোটি টাকা। বর্তমান পরিষেবা নিয়ে বাসিন্দাদের দাবিগুলিকে মেনে নিয়ে অর্ধেন্দুবাবু বলেন, “একাংশের মানুষ বিভিন্ন স্থানে ইচ্ছে মতো পাইপ ফাটিয়ে জল সংগ্রহ করেন। এতে প্রচুর জল নষ্ট হয়। পাথরবোঝাই ভারী গাড়ির জন্যও বহু স্থানে জলের পাইপ নষ্ট হয়ে জল সরবরাহ ব্যাহত হয়।” সম্প্রতি দফতরে আসা ৭২ লক্ষ টাকা দিয়ে পাইপ লাইনের সারাই হবে বলে তিনি জানান। বিকাশবাবুর দাবি, “জলপ্রকল্পের পরিকল্পনাতেই গলদ ছিল। অনেক টাকা বিদ্যুৎ বিল বাকি ছিল। কিছু বকেয়া মিটিয়ে ফের জল দেওয়ার কাজ শুরু করা হয়েছে। মানুষের পানীয় জলের সমস্যা সামগ্রিক ভাবে কীভাবে দূর করা যায়, সে ব্যাপারে আলোচনা চলছে। শীঘ্রই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy