Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

দুই সংস্কৃতির মেলবন্ধন শুলুঙ্গা গ্রামে

দুপুর বারোটা। সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে ছাতা মাথা দিয়ে হেঁটে চলেছেন রুবিন টুডু। ষাটোর্ধ্ব বয়সেও বাড়ির গরুগুলিকে পাথরখাদান এলাকায় ডাঙাতে চরাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরণে খাটো করে হাঁটুর উপর পর্যন্ত ধুতি এবং আধময়লা হাফ হাতা সাদা গেঞ্জি। রামপুরহাট থানার তারাচুয়া মৌজার এবড়ো খেবড়ো পথ ভেঙে এলাকার একটি খাদানের ধারে গাছ তলায় ছায়ায় এসে দাঁড়ালেন তিনি।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
রামপুরহাট শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৪২
Share: Save:

দুপুর বারোটা। সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে ছাতা মাথা দিয়ে হেঁটে চলেছেন রুবিন টুডু। ষাটোর্ধ্ব বয়সেও বাড়ির গরুগুলিকে পাথরখাদান এলাকায় ডাঙাতে চরাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরণে খাটো করে হাঁটুর উপর পর্যন্ত ধুতি এবং আধময়লা হাফ হাতা সাদা গেঞ্জি। রামপুরহাট থানার তারাচুয়া মৌজার এবড়ো খেবড়ো পথ ভেঙে এলাকার একটি খাদানের ধারে গাছ তলায় ছায়ায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। কাঁধের গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে একটু জিরিয়ে নিয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়া রুবিনবাবু বললেন, ‘জোহার মারাঙ বুরু, না পাই মজ, সুলুক, রেকুতেহেন নিঙে এই আরদাশ দহ কাতে নিঙে পুজো’। সাঁওতালি ভাষায় রুবিন টুডুর এই কথাগুলিকে বাংলায় তর্জমা করে দিলেন তাঁর ভাইপো পেশায় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক গোপাল টুডু। যার সারমর্ম হল ‘হে দেবতা বা ভগবান (মারাঙ বুরু) তুমি আমাদের ভালো রাখতে, সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করতে তোমার প্রতি আমাদের এই প্রার্থনা। তুমি আমাদের এই পুজো গ্রহণ কর।’ আদিবাসী সংস্কৃতিতে রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশ দেহি... এই সমস্ত সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ ছাড়া সাঁওতালি ভাষায় নিজেদের মতো করে এই ভাবে দুর্গাকে আবাহন করে আসছেন রামপুরহাট থানার শুলুঙ্গা গ্রামের বাসিন্দাদের সাঁওতাল সম্প্রদায়দের একাংশ।

ওই গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব রুবিন টুডু কুড়ি বছর ধরে শুলুঙ্গা গ্রামের দুর্গা পুজো নিজেই করে আসছেন। রুবিনবাবুর গ্রাম শুলুঙ্গায় এই ভাবে আদিবাসী সংস্কৃতির সঙ্গে হিন্দু ধর্মের মেল বন্ধন ঘটেছে ইংরেজ আমলে। তিনি জানালেন, গ্রামের বাসিন্দা ব্রজ মুর্মু এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন। এলাকার তাঁতবাঁধা তেঁতুলপাহাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক গোপাল টুডুর দাবি, “এক সময় গ্রাম সংলগ্ন ঝাড়খণ্ডে বেনাগড়িয়া এলাকায় ধর্মান্তরীকরণের প্রবনতা প্রকট হারে দেখা দিয়েছিল। যত দূর জানি সেই সময় এলাকার বাসিন্দাদের একাংশ প্রতিরোধ গড়ে তুলে মিলিত প্রচেষ্টায় এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন। মাঝে এক-দু’বার পুজোর দায়িত্ব ভার নিয়ে নিজেদের মধ্যে গণ্ডগোল হলেও চাঁদা তুলে এই পুজো চালিয়ে আসছেন বাসিন্দারা।” গ্রামবাসী কালু মির্ধা বলেন, “আগে গ্রামের শেষপ্রান্তে জঙ্গল পরিষ্কার করে তারপুলিন খাটিয়ে পুজো হতো। পরে সেই জায়গায় মাটি দিয়ে তৈরি খড়ের চালাঘর বানিয়ে দুর্গামণ্ডপ করা হয়। দু’বছর থেকে সেই মাটির চালাঘরের দুর্গামণ্ডপ পাকা দালানের রূপ পেয়েছে। এখনও সন্ধি পুজোর সময় সাদা ছাগ বলিদান দেওয়া হয়।”

গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, পাকা দালানের মণ্ডপে মূর্তি তৈরির কাজে ব্যস্ত রামপুরহাট থানার মদিয়ান গ্রামের শিল্পী ক্যানেল পটুয়া। মণ্ডপের সামনে দাঁড়িয়ে গ্রামের বধূ চিন্তামণি মির্ধা প্রতিমা তৈরি করা দেখছিলেন। মণ্ডপের সামনে পাকা বেদিতে জবা ফুল দেখিয়ে বললেন, “এই গ্রামে শনিবার, মঙ্গলবার, অমাবস্যা, পূর্ণিমাতে মেয়েরা ফুল দিয়ে পুজো করে। দুর্গাপুজোতে মেয়েরা সপ্তমীর ঘট ভরে আনতে গ্রামের ধারে কাঁদরে যাই। দুর্গা প্রতিমার ভাসানের সময় মেয়েরা অংশগ্রহণ করে থাকে।” তবে পুরোহিত রুবিন টুডু সন্ধি পুজো কী কারণে হয়েছিল, কী তার পৌরাণিক ব্যাখ্যা তা তিনি বলতে পারলেন না। তবুও উপবাস থেকে পঞ্জিকা দেখে সময় মিলিয়ে পুজোর যাবতীয় উপাচার সংগ্রহ করে তিনি পুজো করে থাকেন। ছেলে হোপন টুডু-সহ আরও ১০ জন পুজোর আগে গঙ্গা স্নান করেন। পুজোর জন্য গঙ্গা জল এনে পুজোর কটা দিন ব্রাহ্মণের মতো পৈতে পরে পুজোর জন্য ফুল সংগ্রহ করা থেকে ফল কাটা, পুজোর ডালি সাজিয়ে দেওয়া, নৈবদ্য সাজানো, ঠাকুরের ভোগ রান্না করা এ সবই করে থাকেন। রুবিনবাবু বললেন, “আদিবাসীদের মূল দেবতা মারাঙ বুরু। তিনিও ভগবান, মা দুর্গাও ভগবান। তাই আমাদের ভাষায় আমাদের মতো করে এলাকার তথা দশের মঙ্গল কামনায় এই পুজো করে থাকি। এখানে তাই সংস্কৃত বেদমন্ত্র উচ্চারিত হয় না।” শিক্ষক সুনীল সোরেন এই পুজো দেখতে সময় পেলেই সিউড়ি থেকে শুলুঙ্গা গ্রামে একদিনের জন্য হলেও উপস্থিত থাকার চেষ্টা করেন। বললেন, “আসলে আদিবাসীদের মধ্যে মূর্তি পুজোর প্রচলন নেই। একটা এলাকার সংস্কৃতি সেই এলাকার জীবনযাপনের জন্য ঝাঁকজমক, আড়ম্বর, মোহ নিয়ে বেঁচে থাকে। শুলুঙ্গা গ্রামের পুজো হচ্ছে দু’টো সংস্কৃতির মেল বন্ধনের পুজো। আর এই পুজো ঘিরে ওই এলাকায় যে গ্রামীণ মেলা বসে সেখানেও মেল বন্ধন ঘটে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rampurhat apurba chattopadhyay sulunga pujo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE