Advertisement
E-Paper

দাদার দেহের নীচে আমাকেও মড়া ভেবেছিল

চারপাশে নিকষ অন্ধকার। গোবরের গন্ধ। ঝিঁঝিঁ-র ডাক। দূরে গলার আওয়াজ। আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না... রক্ত... রক্ত... খুন... আমি কি বেঁচে আছি? সন্ধ্যায় যখন আমরা তৃণমূল নেতা মনিরুল ইসলামের বাড়িতে বালি খাদান নিয়ে ডাকা সভায় যাই, ভাবতেও পারিনি যে এমন কিছু ঘটতে পারে। শুরুটা তেমন ছিলও না।

জামাল শেখ (লাভপুরে নিহতদের ছোট ভাই)

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৪ ০২:৪০
পরিবার নিয়ে আত্মীয়দের আশ্রয়ে গ্রামছাড়া জামাল। ছবি: অনির্বাণ সেন

পরিবার নিয়ে আত্মীয়দের আশ্রয়ে গ্রামছাড়া জামাল। ছবি: অনির্বাণ সেন

চারপাশে নিকষ অন্ধকার।

গোবরের গন্ধ। ঝিঁঝিঁ-র ডাক। দূরে গলার আওয়াজ।

আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না... রক্ত... রক্ত... খুন... আমি কি বেঁচে আছি?

সন্ধ্যায় যখন আমরা তৃণমূল নেতা মনিরুল ইসলামের বাড়িতে বালি খাদান নিয়ে ডাকা সভায় যাই, ভাবতেও পারিনি যে এমন কিছু ঘটতে পারে। শুরুটা তেমন ছিলও না।

আমরা নয় ভাই বরাবরই সিপিএম করি। বীরভূমের লাভপুরে আমাদের নবগ্রামের পাশেই ময়ূরাক্ষীতে বালিঘাট। আমরা বালি তুলতাম, তখনকার ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মনিরুলের ঘনিষ্ঠ লোকজনও তুলত। ২০০৯-এ লোকসভা ভোটের পরে মনিরুল এবং তাঁর অনুগামীরা তৃণমূলে চলে যান। বিরোধ বাধে। তৃণমূলের লোকজন আমাদের ঘাট থেকে উচ্ছেদ করতে উঠে-পড়ে লাগে। তার ফয়সালা করতেই ওই সভা।

২০১০-এর ৪ জুন সন্ধে সাড়ে ৬টা নাগাদ দাদা সানোয়ারের মোবাইলে ফোন করে আমাদের ডাকা হয়। আমরা ছয় ভাই জাকের আলি, কোটন শেখ, ওইসুদ্দিন শেখ, সাইফুদ্দিন শেখ, সানোয়ার শেখ, আমি এবং সানোয়ারের দুই ছেলে আনোয়ার ও ফিরোজ সভায় যাই। রান্নাঘর লাগোয়া বাঁধানো চাতালে আমাদের বসতে বলা হয়।

সেখানে তখন শ’দেড়েক লোক। দোতলায় কিছু অচেনা মুখও ছিল। গোড়ায় হাসি-মস্করাই হচ্ছিল। খানিক বাদে বালিঘাটের কথা ওঠে। কিছু ক্ষণের মধ্যে আমাদের সঙ্গে তৃণমূলের তর্কাতর্কিও বেধে যায়। তখনই নেতা বলে ওঠেন, ‘ওদের সঙ্গে ফয়সলা আবার কিসের? মেরে শেষ করে দে সব ক’টাকে।’

রান্নাঘরের চালে গুঁজে রাখা শাবল নিয়ে প্রথমে চড়াও হলেন নেতাই। তাঁর দেখাদেখি বাকিরাও লাঠি, টাঙ্গি, বল্লম, তরোয়াল নিয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শাবলের বাড়ি মেরে আমার হাত-পা ভেঙে দেওয়া হল। কাটা কলাগাছের মতো লুটিয়ে পড়লাম আমি। আমার উপরে আছড়ে পড়ল দাদা কোটন। সাড় নেই। যন্ত্রণায় তখন আমার মাথার শিরা ছিঁড়ে যাওয়ার অবস্থা। দাদার রক্তের সঙ্গে আমার রক্ত চোখে-মুখে লেপটে যাচ্ছে। কিন্তু টুঁ শব্দ করলেই ওরা পাছে আমার উপরে ফের ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেই ভয়ে দাঁতে দাঁত চেপে মড়ার মতো পড়ে আছি। আমিও মরে গিয়েছি ভেবে আরও কয়েকটা দেহের সঙ্গে ওরা আমাকেও বাড়ি থেকে তুলে কিছু দূরে গরুর বাথানে ফেলে দিয়ে গেল।

গোবর... ঝিঁঝিঁ.... দূরে কাদের গলা? ওরা কি আবার ফিরে আসতে পারে? ....অন্ধকার নেমে এল চোখে।

জ্ঞান ফিরতে দেখি বোলপুর হাসপাতালে জাকের, কোটন আর ওইসুদ্দিনের মৃতদেহের পাশে শুয়ে আছি। কোটনের মৃতদেহের আড়ালই আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছে। পরে শুনি, বাকি তিন দাদা আর দুই ভাইপো বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু বাড়ির সবাই গ্রামছাড়া। বেঁচে ফেরা সানোয়ারই শুধু এক বার গ্রামে ঢুকে দাদাদের কবরে মাটি দিয়ে এসেছে। মাসখানেক পরে আমাদের বাড়ির লোকেরা একে-একে ফিরতে শুরু করলেন। আমিও হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলাম।

তত দিনে দাদাদের কবরে ঘাস গজিয়ে গিয়েছে। অপেক্ষায় ছিলাম, কবে বিচার শুরু হয়। ইতিমধ্যে বিধানসভা ভোট এসে যায়। লাভপুরের বিধায়ক হন মনিরুল ইসলাম। এলাকায় তৃণমূলের তুমুল দাপট। মামলা তোলার জন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হতে থাকে। আমাদের এক ভাইপো-ভাইঝিকে অপহরণ করা হয়। তাদের ছাড়াতে বিচারকের কাছে জবানবন্দিতে আমরা সাত জন জানাই, মনিরুল নির্দোষ।

আদালত থেকে ফেরার পরেই আমাদের সবাইকে ফের গ্রামছাড়া হতে হয়। ভাইপো-ভাইঝিকে ফিরে পেলেও গ্রামে ঢোকার সাহস হয়নি আর। বছর তিনেক যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি। গ্রামে পড়ে রয়েছে পাকা দালানবাড়ি, ন’ভাইয়ের প্রায় ৮০ বিঘা জমি। এক আত্মীয়ের দেওয়া একচিলতে জমিতে ছোট্ট চালাঘর তুলে স্ত্রী আর তিন ছেলেকে নিয়ে ঠাঁই নিয়েছি। ভাঙা হাত-পা কমজোরি। মুনিষ খাটা দূরের কথা, বেশি ক্ষণ দাঁড়িয়েই থাকতে পারি না। লোকের কাছে চেয়ে-চিন্তে সংসার চলে। টাকার অভাবে ছেলেদের পড়াশোনা বন্ধ। এক দিন আমরা বছরভর মুনিষ খাটিয়েছি। এখন আমার দাদারা পরের বাড়িতে কাজ করে পেট চালাচ্ছেন। আমাদের পাঁচটা সাবমার্সিবল পাম্প এবং সাতটি শ্যালোর মোটরও ওরা চুরি করে নিয়ে গিয়েছে বলে শুনেছি।

সানোয়ার হাইকোর্টে ফের প্রকৃত ঘটনার জবাবনন্দি দেওয়ার জন্য আবেদন করেছে। আর এক বার যদি সুযোগ পাই... রাতে ঘুম আসে না, জানেন? চমকে জেগে উঠি! রক্ত, রক্ত... দাদাদের রক্তমাখা মুখ....

(অনুলিখন: অর্ঘ্য ঘোষ)

lavpur jamal sekh birbhum muder case
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy