Advertisement
১৬ মে ২০২৪

দুর্গাপটের তুলি এ বার নবীন প্রজন্মের হাতে

শিল্পীর ছেলে শিল্পীই হবে প্রচলিত এই ধারণ ভেঙে অনেকে পৈতৃক পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। ব্যতিক্রম বিষ্ণুপুরের ফৌজদার বাড়ি। পরাম্পরা বজার রেখে এই বাড়ির ছেলেরা এখনও ঐতিহ্যবাহী পটের দুর্গা এঁকে যাচ্ছেন। এ বার পিতৃপুরুষের হাত থেকে সেই রং-তুলি তুলে নিয়েছেন বংশের নবীন প্রজন্মের দুই ছেলে সম্রাট ও সন্দীপ।

হাতে হাতে। পটের দুর্গা আঁকতে দুই নাতি সম্রাট ও সন্দীপকে সাহায্য করছেন দুলালি ফৌজদার। ছবি: শুভ্র মিত্র

হাতে হাতে। পটের দুর্গা আঁকতে দুই নাতি সম্রাট ও সন্দীপকে সাহায্য করছেন দুলালি ফৌজদার। ছবি: শুভ্র মিত্র

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৫৯
Share: Save:

শিল্পীর ছেলে শিল্পীই হবে প্রচলিত এই ধারণ ভেঙে অনেকে পৈতৃক পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। ব্যতিক্রম বিষ্ণুপুরের ফৌজদার বাড়ি। পরাম্পরা বজার রেখে এই বাড়ির ছেলেরা এখনও ঐতিহ্যবাহী পটের দুর্গা এঁকে যাচ্ছেন। এ বার পিতৃপুরুষের হাত থেকে সেই রং-তুলি তুলে নিয়েছেন বংশের নবীন প্রজন্মের দুই ছেলে সম্রাট ও সন্দীপ।

বড়ঠাকুরণ, মেজো ঠাকরুণ ও ছোট ঠাকরুণ পটের তিন দেবী ফৌজদার বাড়ি থেকে যায় বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজবাড়িতে। এ বারও গিয়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি সুপ্রাচীন পুজোতেও পটের দুর্গা যাচ্ছে। সবই তৈরি হয়েছে বিষ্ণুপুরের মনসাতলার ফৌজদার বাড়িতে। তবে এ বার বাপ-কাকাদের হাত থেকে পটের ছবি আঁকার দায়িত্ব কেড়ে নিয়েছেন দুই সহোদর। তাঁদের সাহায্য করেছেন ঠাকুমা দুলালিদেবী।

বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত পট শিল্পের কথা উঠলেই এখনও সমঝদার লোকজন এক বাক্যে ভাস্কর ফৌজদারের নাম স্মরণ করেন। এই ফৌজদার পরিবারের সবার মজ্জায় যেন রং-তুলি। কয়েক বছর হল ভাস্করবাবু মারা গিয়েছেন। এর পরে সেই রং-তুলি হাতে তুলে নিয়েছিলেন তাঁর ভাইপো শীতল ফৌজদার। এখন তিনি মাটির দেবী প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত। সময় দিতে পারেন না পটে। কিন্তু পরম্পরা যাতে হারিয়ে না যায় তাই ভাস্করবাবুর দুই স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া নাতি সম্রাট ও সন্দীপ তুলি ধরেছেন। তাঁদের হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন শীতলবাবু।

কিছু দিন আগে মনসাতলায় ওই শিল্পীদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, লণ্ঠনের ভুষো, খড়ি মাটি, সিমপাতা, নীলবড়ি, হলুদ বেটে দেশীয় পদ্ধতিতে রং তৈরি করছেন দুলালিদেবী। বাড়ির অন্য মেয়েরা সংসার সামলে বেলের আঠা ও ছেঁড়া কাপড়-চোপড় জড়ো করে বসে গেছেন পটের মণ্ড তৈরিতে। তা রোদে শুকচ্ছিল বাড়ির বাচ্চারা।

আর নারকোল খোলায় তুলি ডুবিয়ে পটের গায়ে দশভুজার রূপ দিচ্ছেন সম্রাট। তিনি স্থানীয় রামানন্দ কলেজের দর্শন শাস্ত্রের ছাত্র। তাঁর ভাই সন্দীপ এখনও স্কুল পড়ুয়া। এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। দাদার পাশে বসে ফুটিয়ে তুলছেন দেবীর হাতের দশ আয়ূধ। মনে পড়ে যায় ভাস্করবাবুর কথা। তিনিও শরৎ-র এই সময়ে এমনই ভাবে পটের দুর্গা আঁকতেন।

পটের চালচিত্রে কার্তিক-গণেশ, লক্ষ্মী-সরস্বতী, সিংহের থাবায় ধরাশায়ী অসুর সবই রূপ পাচ্ছে নানা রঙে। ত্রুটি দেখলেই মাটির মূর্তি তৈরির কাজ ফেলে দুই নবীন শিল্পীর ভুল ধরিয়ে দিচ্ছেন শীতলবাবু। কাজের ফাঁকে তিনিই বললেন, “বরাবরের মতো বিষ্ণুপুর ও কুচিয়াকোল রাজবাড়ির চারটি পট এ বারও আমরা আঁকছি। এ ছাড়া তিনটি পারিবারিক পুজোর পট আঁকার কাজও চলছে। প্রতিটি পটের মাপ তিন ফুট লম্বা ও দু’ফুট চওড়া।”

শীতল জানান, দুর্গা পুজো ছাড়াও মনসা পুজোয় মনসার পটের ভাল অর্ডার থাকে। এ ছাড়া এখন লক্ষ্মী, গণেশ বা সরস্বতী পুজোতেও অর্ডার আসছে। আয় কম হলেও ঐতিহ্যের এই লোকায়ত শিল্পকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না।

বিষ্ণুপুরে এই শিল্পের ইতিহাসের কথা বলতে গিয়ে আচার্য যোগেশচন্দ্র সংগ্রহশালার সচিব চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, “শতাব্দী প্রাচীন এখানকার মল্ল রাজবাড়ির পুজোয় পট এঁকে আসছেন ফৌজদার পরিবারের শিল্পীরা। পরম্পরা বজায় রেখে সেই কাজ ধারাবাহিক ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ওই পরিবারের নবীন প্রজন্ম। এটা অবশ্যই আশার কথা।” তিনি জানান, দেশীয় রং ব্যবহার এই পটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যার জোরে বিষ্ণুপুরি পটের সুনাম এখনও অক্ষুন্ন। এঁদের আঁকা দশাবতার তাসও বাংলার লোকশিল্পের চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

পরিবারের সেই সুনাম আজীবন বয়ে বেড়ানোর ইচ্ছের কথা জানিয়ে এ কালের নবীন পটুয়া সম্রাট বলেন, “পড়াশোনার শেষে শিক্ষকতা করতে চাই। কিন্তু পারিবারিক ঐতিহ্যের এই শিল্পকে বিসর্জন দিতে চাই না। শত ব্যস্ততার মধ্যেও রং-তুলি নিয়ে বসবই। বিশেষ করে দুর্গা পুজোয় পটে মায়ের চোখ না আঁকলে নিজেদেরই দৃষ্টিহীন মনে হবে।” দাদার পাশে বসে ঘাড় নাড়ে সন্দীপও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

swaspan bandyopadhyay bishnupur pujo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE