Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নানুর এখনও মজে সেই চণ্ডীদাসে

বৃন্দাবনে যেমন কানু ছাড়া গীত নাই, চণ্ডীদাস ছাড়া কথা নাই নানুরে! এ নেহাত মিল খোঁজা নয়, নানুর নামের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাসের নাম। এখনও একই শব্দ-বন্ধে তাই মানুষ বলে থাকেন চণ্ডীদাস-নানুর। সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রজকিনী-রামীর নামও। বৈষ্ণব পদকর্তা রূপে চণ্ডীদাসের নাম সাহিত্যের ইতিহাসকারদের কাছে যেমন সুবিদিত, বিতর্কিতও। তাঁর পরিচয় নিয়ে নানা মুনির নানা মত। সাহিত্যের ইতিহাসে চণ্ডীদাস নামের একাধিক পদকর্তার সন্ধান মেলে।

বৈষ্ণব কবির স্মৃতি বিজড়িত বিশালাক্ষী মন্দির।

বৈষ্ণব কবির স্মৃতি বিজড়িত বিশালাক্ষী মন্দির।

অর্ঘ্য ঘোষ
নানুর শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৩৯
Share: Save:

বৃন্দাবনে যেমন কানু ছাড়া গীত নাই, চণ্ডীদাস ছাড়া কথা নাই নানুরে! এ নেহাত মিল খোঁজা নয়, নানুর নামের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাসের নাম। এখনও একই শব্দ-বন্ধে তাই মানুষ বলে থাকেন চণ্ডীদাস-নানুর। সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রজকিনী-রামীর নামও।

বৈষ্ণব পদকর্তা রূপে চণ্ডীদাসের নাম সাহিত্যের ইতিহাসকারদের কাছে যেমন সুবিদিত, বিতর্কিতও। তাঁর পরিচয় নিয়ে নানা মুনির নানা মত। সাহিত্যের ইতিহাসে চণ্ডীদাস নামের একাধিক পদকর্তার সন্ধান মেলে। বৈষ্ণব সাহিত্যে তার মধ্যে দ্বিজ চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস এবং বড়ু চণ্ডীদাস নামে ৪ জন পদকর্তার উল্লেখ সব চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। কোনও কোনও সাহিত্যের গবেষক বলেন, চার জনই একই ব্যক্তি। একাংসের মতে, যে পদকর্তার বিভিন্ন রচনায় নানুর এবং সংলগ্ন এলাকার কথা ঘুরে ফিরে এসেছে তিনিই নানুরের চণ্ডীদাস।

পরবর্তীকালে নানুরের চণ্ডীদাসের স্বতন্ত্র পরিচিতি ঘটেছে। রামী চণ্ডীদাস হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছেন নানা জনের লেখায়। এখনও কবির সঙ্গে সমোচ্চারিত হয় তাঁর প্রেম-সাধিকা রামীর নামও। চণ্ডীদাসের বিভিন্ন পদেও রয়েছে তার উল্লেখ। স্বভাবতই কবির পাশাপাশি তাঁর প্রেমিকাকে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছেন এলাকার মানুষ। কবির সঙ্গে তাঁর যুগল মুর্তি নির্মাণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামকরণ সেই উদ্যোগেরই নজির। যে ঘাটে রামী কাপড় কাচতেন সম্প্রতি সেটি বিধায়কের এলাকা উন্নয়নের টাকায় পাকা হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে রজকিনীর ঘাট। যে পাটাতে রজকিনী কাপড় কাচতেন সেটিও সযত্নে রাখা আছে, ঘাট লাগোয়া রক্ষাকালী মন্দিরের পাশে। ভ্রমনার্থীরা ওই ঘাট ও পাটা দেখতে ভিড় জমান নিত্য।

নানুরে রামী-চণ্ডীদাসকে ঘিরে যে মিথটি প্রচলিত রয়েছে সেখানে রামী একজন বাল্য বিধবা। জমিদারের নির্দেশে গ্রামদেবী বিশালাক্ষীর মন্দিরে পরিচারিকার কাজে বহাল হন। ওই সময় মন্দিরের পুজারির দায়িত্বে ছিলেন চণ্ডীদাস। তাঁরই প্রচেষ্টায় এবং দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মন্দিরে প্রবেশাধিকার পান তথাকথিত ‘অছুত’ ধোপানি রামী। ক্রমে দু’জনের প্রণয় জন্মায়। কথিত আছে, রামী যখন ঘাটে কাপড় কাচতেন, তখন ছিপ হাতে পুকুর পাড়ে বসে থাকতেন চণ্ডীদাস।

এই প্রণয় অবশ্য জমিদার এবং সেই সময়ের সমাজপতিরা ভাল চোখে দেখেন নি। কবি রামীকে ত্যাগ না করলে চণ্ডীদাসের বাবার সত্‌কার করতে পর্যন্ত অস্বীকার করে সে সময়ের সমাজ। কিন্তু রামীকে ত্যাগ করেননি চণ্ডীদাস। দু’জনের এই অনুরাগ দেখে অবশেষে রামীকে চণ্ডীদাসের সাধনসঙ্গিনী হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য হন সবাই।


রামী-চণ্ডীদাসের মূর্তি।

চণ্ডীদাসের জন্মের মতোই মৃত্যু নিয়েও নানা মত রয়েছে। একটি মত হল, একদিন বিশালাক্ষী মন্দিরের আটচালায় কীর্তন গানে বিভোর ছিলেন সাধক কবি। তাতে যোগ দিয়েছিলেন নবাবের বাড়ির মহিলারাও। তাই নবাবের নির্দেশে কামান দাগা হয় ওই আসরে। তাতে সকলেই ধংসস্তুপে চাপা পড়েন। সে স্তুপ আজও রয়েছে। পুরাতত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ একেই চণ্ডীদাসের সমাধি হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সমাধিক্ষেত্র এবং বিশালাক্ষী মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের ভারও তারা নিয়েছে।

নানুরে রামী-চণ্ডীদাসকে ঘিরে এমন নানা গল্প-গাথা ছড়িয়ে রয়েছে। অতীতের নানা নির্দশনও ছড়িয়ে রয়েছে নানুরের আনাচে-কানাচে। অনায়াসেই ওইসব নির্দশন ঘিরে একটি পর্যটনক্ষেত্র গড়ে তোলা যায় বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি। কিন্তু এলাকার রক্ষাকালীতলায় একটি অতিথি আবাস ছাড়া তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি এতদিনেও।

নানুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন তেরাস্তার মোড়ে রামী-চণ্ডীদাসের যুগল মূর্তির দিকে কারও নজর পড়ে না। বছর দশেক আগে প্রশাসনিক উদ্যোগে ওই যুগল মূর্তি তৈরি হয়েছিল। সেই মূর্তিও অবহেলায় অনাদরে পড়ে। শুধুমাত্র দোল এলেই পরিষ্কার হয় মূর্তিটি। সোনালি রঙের মূর্তির সর্বাঙ্গ ধুলোময়। মূর্তির চারপাশে গ্রিলের ঘেরার ভিতরে প্লাস্টিক-ফাইবারের কাপ-ডিস পড়ে। গ্রিল ঘিরে ব্যবসায়ীদের পসরায় ঢেকে চণ্ডীদাস-রামীর মুখ!

জেলার মানচিত্রে বোমা-বারুদের রাজনীতির আতুরঘর বলে নয়, বহু কাল আগে থেকেই নানুর খ্যাত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চণ্ডীদাসের জন্য। প্রাচীন এই কবির নাম সেই কারণেই জুড়ে গিয়েছে এখানকার গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে স্কুল কলেজ গ্রন্থাগার, সবজি বাজারের সঙ্গেও। স্থানীয়দের দাবি, কবির কীর্তিকে স্মরণে রেখে, তাঁর স্মৃতি-চিহ্নগুলির সংরক্ষণে তাঁদের সঙ্গে প্রশাসনের সহযোগিতাও কাম্য। এখানেই স্থানীয়দের সহযোগিতায় গড়ে তোলা যায় পর্যটনক্ষেত্র।

তৃণমূল বিধায়ক গদাধর হাজরা বলেন, “ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আর্কষণ করেছি। আশ্বাসও মিলেছে।”

ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar shohor chandidas nanur arghya ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE