Advertisement
১১ মে ২০২৪

নারী দিবসে অন্য জীবনের স্বাদ পেলেন প্রাণমণিরা

কোলে তিন মাসের শিশুকে নিয়ে বাঘমুণ্ডির ধসকা গ্রাম থেকে এসেছেন পূর্ণিমা মাঝি। কোটশিলার ধাদকিগড়্যা থেকে এসেছেন সুমিত্রা সিং এসেছেন বোনকে অঞ্জলিকে নিয়ে।

ছোটবেলা থেকে মেয়েদের জীবন কী ভাবে সামাজিক অনুশাসনে বাধা পড়ে যায়, তারই প্রতীকী এই মূর্তি। বরাবাজারে। —নিজস্ব চিত্র।

ছোটবেলা থেকে মেয়েদের জীবন কী ভাবে সামাজিক অনুশাসনে বাধা পড়ে যায়, তারই প্রতীকী এই মূর্তি। বরাবাজারে। —নিজস্ব চিত্র।

সমীর দত্ত
বরাবাজার শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৫ ০০:২৪
Share: Save:

কোলে তিন মাসের শিশুকে নিয়ে বাঘমুণ্ডির ধসকা গ্রাম থেকে এসেছেন পূর্ণিমা মাঝি।

কোটশিলার ধাদকিগড়্যা থেকে এসেছেন সুমিত্রা সিং এসেছেন বোনকে অঞ্জলিকে নিয়ে।

মেলা বা যাত্রার আসরে নয়, দূরদূরান্ত থেকে রবিবার বরাবাজারের এটিম গ্রাউন্ডে মহিলারা এসেছিলেন নিজেদের কথা বলতে। অন্যদের কথা শুনতেও। দুঃখ-দুর্দশার কথা নয়, জীবন-যুদ্ধে উত্তরণের কাহিনি শুনতে, দেখতে। ২০১২ সাল থেকে আর্ন্তজাতিক নারী দিবসে একদিনের দিবা-রাত্রির এই অনুষ্ঠানে যে একবার এসেছেন, পরেরবার তিনি নেশাগ্রস্তের মতো এখানে ছুটে আসেন। বাচ্চাকাচ্চা সামলানো আর হেঁসেল ঠেলার বারোমাস্যার মধ্যে এ দিনটা অন্য জীবনের স্বাদ পাইয়ে দিয়ে যায়।

বাঘমুণ্ডির প্রাণমণি হাঁসদা যেমন বলেন, “গত তিন বছর ধরে এখানে আসছি। এই দিনটার জন্য সারা বছর ধরে আমরা অপেক্ষা করে থাকি। এখানে না এসে পারি না।” কলকল করতে করতে সঙ্গীদের নিয়ে প্যান্ডেলে ঢুকে গেলেন ওঁরা। প্যান্ডেলের মূল দরজার সামনে প্রতীকী এক নারী মূর্তির মডেল রাখা ছিল। মূর্তিটিকে বিভিন্ন সামাজিক অনুশাসন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে । এই বন্ধন কাটিয়ে ওঠাই সমাবেশের মূল বার্তা ছিল। প্যান্ডেলের ভিতরে তখন মহিলাদের সারি সারি মাথা।

একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে ২০১২ সাল থেকে এই মহিলা সমাবেশ হয়ে আসছে। সবাই প্রায় দিন মজুর এবং গৃহবধূ। আয়োজক সংস্থা সবুজ সাথী নারী শক্তি সঙ্ঘের অন্যতম নেত্রী সন্ধ্যা ষড়ঙ্গী, চিন্তামণি কুমার বলেন “এ দিন আড়াই হাজারের বেশি মহিলা এসেছেন। নারী দিবস উদ্যাপনের জন্য পুরুলিয়া জেলার বরাবাজার, বাঘমুণ্ডি, কাশীপুর, ঝালদা ১ ও ২ ব্লক এমনকী পাশের জেলা বাঁকুড়া থেকেও মহিলারা এখানে এসেছেন। সবাই মিলে নিজেদের কথা জানালেন। আমরাও আরও ভালভাবে কী ভাবে বাঁচা যায়, সে কথাই আলোচনা করা হল।”

বরাবাজারের বেড়াদা গ্রামের সারথি কুম্ভকার, ডিগারডি গ্রামের কল্যাণী কুম্ভকার বলেন, “এই অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা তৈরি থেকে আয়োজন, অতিথিদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ার ব্যবস্থা, আলো, মাইক, গাড়িসহ অনুষ্ঠানের সব খুঁটিনাটি আমরা করেছি। কোথাও আমরা ছেলেদের সাহায্য নিইনি। সমাবেশের খরচ তুলতে আমরা নিজেরাই চাঁদা দিয়েছি। বাইরের কারও কাছ থেকে আমরা এক পয়সাও নিইনি।’’ আত্মবিশ্বাসী শোনাচ্ছিল ওঁদের গলা। রবিবার এটিম গ্রাউন্ডের সমাবেশে এক চক্কর দিয়ে বরাবাজার থানার মেজোবাবু ফলারি কুমার বলেন, “দুপুরের মধ্যেই দেখছি প্যান্ডেল ভর্তি হয়ে গিয়েছে। খবর পেয়েছি বিভিন্ন রাস্তা ধরে আরও মহিলা মিছিল করে আসছেন।”

মঞ্চে কেউ গান গাইলেন, কেউ সমবেত ভাবে নাচলেন। ধামসা-মাজল বাজালেন মেয়েরাই। কেউ নিজের লেখা গল্প পাঠ করে শোনালেন। তাতে যেমন অনেকে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলেন। তেমনই ১০০ দিনের কাজে বা জনমজুরি খাটতে গিয়ে বঞ্চনার অভিজ্ঞতার কথা যখন কেউ শোনালেন, তখন অনেক শ্রোতাকেই দুঃখ করতেও দেখা গেল। এ ছাড়া মদভাটি তুলে দেওয়া, রেশনে মাল কম দিলে তার মোকাবিলা করা, একশো দিনের কাজে কী ভাবে ফর্ম পূরণ করতে হবে কিংবা বিডিওর কাছে কী ভাবে সাহায্যের আবেদন জানাতে হবে তা বিভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করা হয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলল এই অনুষ্ঠান।

বাইরে ছিল স্টল। সেখানেও অপেক্ষা করছিল চমক। মহিলাদের হাতের নানা কাজ ছিল। চোখ টেনেছে নবসাক্ষরদের সংস্থার মহিলা সদস্যদের প্রকাশিত চার পাতার পত্রিকা। দেদার বিক্রিও হয়েছে। এই সব কাগজে মহিলারাই লেখক। প্রকাশক ও বিক্রির দায়িত্বেও মহিলারাই। চিন্তামণি বলেন, “এ পর্যন্ত আমাদের ১৭৫টি স্বনির্ভর মহিলা দল গঠিত হয়েছে। ২২টি শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। যেখানে আমাদের সদস্যরাই অন্যদের নবসাক্ষর করার দায়িত্বে রয়েছেন। মূলত মহিলাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা, কর্মক্ষেত্রের কোনও জায়গায় তাঁরা যাতে পিছিয়ে না থাকেন, সেই বোধটাই জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। প্যান্ডেলের গায়ে নবসাক্ষরদের হাতে তৈরি কাঁথার উপর অক্ষর পরিচয় অনেকের প্রশংসা কুড়িয়েছে।

বরাবাজার থানার বাঁশবেড়া গ্রামের সন্ধ্যা মাহাতো বামু গ্রামের অঞ্জনা মাহাতো বলেন, “সামাজিক অনুশাসনের নামে প্রতিনিয়ত আমাদের পিছনে টেনে ধরা হয়। এখানে না এলে আমরা মহিলাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারতাম না। বরাবাজারের বিডিও অনিমেষকান্তি মান্না বলেন, “অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে যাবতীয় হিসাবনিকাশ মহিলারাই সামলেছেন। কয়েক হাজার মহিলা নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছেন এটা বড় কম কথা নয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

barabazar samir dutta international women's day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE