Advertisement
০৩ মে ২০২৪

প্রদীপ-কাঁটা সরিয়েও দ্বন্দ্ব বহাল

একাধিক গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে অনাস্থা আনিয়ে দলের জেলা নেতৃত্বের রোষানলে পড়ে বৃহস্পতিবারই পদ খুইয়েছেন রঘুনাথপুর ১ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি প্রদীপ মাজি। তাঁর জায়গায় ব্লকের সাংগঠনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রঘুনাথপুরের বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র মাজিকে। কিন্তু, তাতেও যে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব পুরোপুরি শেষ করা যায়নি, তা শুক্রবার টের পেলেন খোদ বিধায়কই!

সহ-সভাপতি নির্বাচন ঘিরে কড়া পুলিশি পাহারা রঘুনাথপুর ১ ব্লক অফিসে। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র

সহ-সভাপতি নির্বাচন ঘিরে কড়া পুলিশি পাহারা রঘুনাথপুর ১ ব্লক অফিসে। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
রঘুনাথপুর শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:২৭
Share: Save:

একাধিক গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে অনাস্থা আনিয়ে দলের জেলা নেতৃত্বের রোষানলে পড়ে বৃহস্পতিবারই পদ খুইয়েছেন রঘুনাথপুর ১ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি প্রদীপ মাজি। তাঁর জায়গায় ব্লকের সাংগঠনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রঘুনাথপুরের বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র মাজিকে। কিন্তু, তাতেও যে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব পুরোপুরি শেষ করা যায়নি, তা শুক্রবার টের পেলেন খোদ বিধায়কই!

ব্লকের সংগঠনের দায়িত্ব পেয়ে রঘুনাথপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির সদ্য অপসারিত সহ-সভাপতি রীনা বাউরিকে এ দিন ভোটাভুটিতে জিতিয়ে ফের ওই পদে পুনর্নির্বাচিত করালেও দলীয় দ্বন্দ্ব এড়াতে পারলেন না বিধায়ক। এ দিন ভোটের সময় রীনাদেবীর বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছিলেন অপসারিত ব্লক সভাপতি প্রদীপবাবুর অনুগামী সদস্যেরা। ফলে, ভোটাভুটি এড়াতে পারেননি বিধায়ক। পঞ্চায়েত সমিতিতে তৃণমূলের ১৭ জন সদস্যর মধ্যে ১১ জনেরই ভোট পেয়েছেন রীনাদেবী। কিন্তু, বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর প্রার্থী সঞ্জয় বাউরির পক্ষে পড়া ছ’টি ভোট জানান দিচ্ছে, দাপুটে ব্লক সভাপতিকে সরিয়েও ওই এলাকায় দলের দ্বন্দ্ব নির্মূল করা যায়নি। বিডিও (রঘুনাথপুর ১) সুনীতিকুমার গুছাইত বলেন, “সহ-সভাপতি নির্বাচনের সভায় সমিতির ২১ জন সদস্যের সকলেই উপস্থিত ছিলেন। তবে, সিপিএমের চার সদস্য ভোটদানে বিরত ছিলেন।”

সহ-সভাপতি পদে রীনাদেবীর পুনর্নির্বাচন ঠেকাতে মরিয়া হলেও তাতে ব্যর্থ হয়ে ভোটাভুটি শেষে পার্টি অফিসে নিজের অনুগামীদের নিয়ে বৈঠক করেন প্রদীপবাবু। তাতে উপস্থিত ছিলেন পঞ্চায়েত সমিতির কিছু সদস্য, বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতের একাধিক সদস্য ও প্রধান এবং ব্লকের অঞ্চল কমিটির সদস্যেরা। ওই বৈঠকে প্রদীপবাবুর ডানা ছাঁটা প্রশ্নে দলের জেলা নেতৃত্বের তুমুল সমালোচনা করা হয়েছে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। প্রদীপবাবুর দাবি, “আর্থিক-সহ বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে আমাদের দলেরই নেতারা সমিতির কিছু সদস্যকে ভাঙিয়েছেন।” পরবর্তী সময়ে তাঁরা তৃণমূলে থাকবেন কি না, সেই নিয়েও ভাবনাচিন্তা করছেন বলে জানিয়েছেন প্রদীপবাবু। যদিও শান্তিরামবাবু বলেছেন, “ব্লক সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরেও প্রদীপ পার্টি অফিসে কী ভাবে মিটিং করলেন এবং কারা ছিলেন সেই মিটিংয়ে, তা আমরা খতিয়ে দেখে দলীয় ভাবে যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেওয়া হবে।”

তৃণমূলের দখলে থাকা এই পঞ্চায়েত সমিতিতে দলেরই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে সম্প্রতি অনাস্থায় অপসারিত হতে হয়েছিল সমিতির সহ-সভাপতি রীনাদেবীকে। অনাস্থা তৃণমূলের যে সদস্যেরা এনেছিলেন, তাঁরা প্রদীপবাবুর অনুগামী। শুক্রবার ছিল নতুন সহ-সভাপতি নির্বাচনের দিন। তার ঠিক আগেই বৃহস্পতিবার প্রদীপবাবুকে ব্লক সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে স্থানীয় বিধায়ককে ওই ব্লকের সাংগঠনিক দায়িত্ব দেন জেলা তৃণমূল সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো। তৃণমূল সূত্রের খবর, রীনাদেবীকেই ফের সহ-সভাপতি পদে চাইছিলেন জেলা নেতৃত্ব। কিন্তু, প্রদীপবাবু ফের রীনাদেবীকে ওই পদে না ফেরানোয় অনড় থাকায় ব্লকের দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরিয়ে নির্দিষ্ট বার্তা দিয়েছেন জেলা সভাপতি। কিন্তু, এত করেও দ্বন্দ্ব এড়াতে পারল না শাসকদল। বরং এ দিন সহ-সভাপতি নির্বাচনে ভোটাভুটি থেকে এটা স্পষ্ট যে, রঘুনাথপুর ১ ব্লকে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চরম আকার নিয়েছে।

বৃহস্পতিবার প্রদীপবাবুকে সরানোর খবর ছড়ানোর পরেই রাতে তাঁর অনুগামী, পঞ্চায়েত সমিতির জনা ১২ তৃণমূল সদস্য পুরুলিয়ায় দলের জেলা কার্যালয়ে গিয়ে প্রদীপবাবুকে ফের ব্লকের দায়িত্বে না ফেরালে দলত্যাগের হুমকি দিয়ে এসেছিলেন। এই অবস্থায় রীনাদেবীকে সহ-সভাপতি পদে পুনর্নির্বাচিত করাকে এক অর্থে চ্যালেঞ্জ হিসাবেই নিয়েছিলেন ব্লকে প্রদীপবাবুর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতারা। এ দিন ভোটাভুটির পুরো সময়টাই ব্লক অফিসের অদূরে একটি দোকানে বসেছিলেন বিধায়ক। অন্য দিকে, প্রদীপবাবু ছিলেন কিছুটা দূরে ব্লক তৃণমূলের কার্যালয়ে।

শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে নির্বাচন চলাকালীন অবাঞ্চিত ঘটনা এড়াতে চারটি থানার ওসি-সহ পুলিশকর্মীদের নিয়ে ব্লক অফিসে উপস্থিত ছিলেন রঘুনাথপুরের এসডিপিও পিনাকী দত্ত। ছিলেন রঘুনাথপুর মহকুমা প্রশাসনের দুই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ব্লক অফিস চত্বরে ১৪৪ ধারাও জারি করেছিল প্রশাসন। সব মিলিয়ে, নির্বাচন ঘিরে যথেষ্ট উত্তেজনা ছিল এলাকায়।

দিনের শেষে অবশ্য শেষ হাসিটা হাসলেন বিধায়কই। দিন পনেরো আগে পঞ্চায়েত সমিতির যে ১২ জন সদস্য রীনাদেবীর বিরুদ্ধে অনাস্থার চিঠিতে সই করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছয় জন এ দিন ভোটাভুটির সময় ফের তাঁকেই সমর্থন জানিয়েছেন! তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “এত দিন প্রদীপবাবুর দিকে থাকলেও দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে তাঁর হাত থেকে ব্লকের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার পরেই সমিতির কিছু সদস্য বুঝতে পেরেছেন, দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচারণ করলে দলের কোপে তাঁরাও পড়তে পারেন। সেই ভয় থেকেই ওই সদস্যেরা দলের সিদ্ধান্তকে (রীনাদেবীকে পুনর্নির্বাচিত করা) সমর্থন জানিয়েছেন।”

এত করেও অবশ্য দ্বন্দ্বের কাঁটা রয়েই যাচ্ছে শাসক-শিবিরে। ক্ষমতা হারিয়ে দলের জেলা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছেন প্রদীপবাবু। তাঁর অভিযোগ, “আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে পঞ্চায়েত সমিতি পরিচালনা করছিলাম। কিন্তু, আমাদের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট চালানোর মতো অভিযোগ তোলা হচ্ছে। আসলে রঘুনাথপুর এলাকায় অবৈধ কয়লার কারবার বন্ধ বলে সেখান থেকে এখন আর মোটা টাকা পাচ্ছে না দলের কিছু নেতা। তাই ব্লকের দায়িত্ব থেকে আমাকে সরিয়ে পঞ্চায়েত সমিতির দখল নিয়ে ওই সূত্র থেকে টাকা কামাতে চাইছেন তাঁরা।”

অভিযোগ প্রসঙ্গে শুনে বিধায়ক পূর্ণচন্দ্রবাবুর প্রতিক্রিয়া, “মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।” আর দলের জেলা সভাপতি শান্তিরামবাবুর বক্তব্য, “দলের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ায় প্রদীপের মাথা আর কাজ করছে না। তাই উল্টোপাল্টা বকছেন!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

raghunathpur pradip maji tmc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE