Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বেড জোটে না, মেঝেই ভরসা রোগীর

ঘটনা ১: মধ্যরাতে প্রসূতি বিভাগের দরজার পাশে আগুন লেগেছিল। সদ্যপ্রসবা মায়েরা ঘুম ভেঙে আতঙ্কে নবজাতককে আঁকড়ে ছুট লাগিয়েছিলেন। আসন্নপ্রসবারা আলুথালু পায়ে ঘর ছেড়ে বারান্দায় পালান। হিমশীতল রাতে তাঁদের সঙ্গে অন্য বিভাগে ভর্তি থাকা রোগীরাও ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে রাত কাটিয়েছিলেন।

চাহিদা বাড়লেও মানবাজার হাসপাতালে শয্যা বাড়েনি। বারান্দায় শুয়ে থাকেন রোগীরা। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।

চাহিদা বাড়লেও মানবাজার হাসপাতালে শয্যা বাড়েনি। বারান্দায় শুয়ে থাকেন রোগীরা। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।

সমীর দত্ত
মানবাজার শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:১৭
Share: Save:

ঘটনা ১: মধ্যরাতে প্রসূতি বিভাগের দরজার পাশে আগুন লেগেছিল। সদ্যপ্রসবা মায়েরা ঘুম ভেঙে আতঙ্কে নবজাতককে আঁকড়ে ছুট লাগিয়েছিলেন। আসন্নপ্রসবারা আলুথালু পায়ে ঘর ছেড়ে বারান্দায় পালান। হিমশীতল রাতে তাঁদের সঙ্গে অন্য বিভাগে ভর্তি থাকা রোগীরাও ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে রাত কাটিয়েছিলেন। পরে আগুন আয়ত্তে আসে। জেনারেটর বিগড়ে যাওয়ায় টর্চ জ্বালিয়ে সন্তান প্রসব করাতে হয়েছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খোঁজ নিয়ে জানিয়েছিলেন, ছাদ থেকে চুঁইয়ে পড়া জল বিদ্যুতের তারে লেগে শর্ট সার্কিট হয়ে এই বিপত্তি। ২০১৩-র ডিসেম্বরের এই ঘটনার পরে মানবাজার গ্রামীণ হাসপাতালের হাল বিশেষ কিছু বদলায়নি। বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেল, এখনও একই রকম মাকড়সার জালের মতো বিদ্যুতের তার ছড়িয়ে রয়েছে।

ঘটনা ২: বাস দুর্ঘটনায় প্রায় ১৯ জন আহতকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা দেখেন স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা কম। তাঁরাই দৌড়ঝাঁপ করে গজ-ব্যান্ডেজ, স্যালাইনের বোতল এনে দিলেন। অনেকে দৌড়ে গিয়ে স্ট্রেচার টেনে এনে রোগীদের ওয়ার্ডের ভিতরে নিয়ে যান। ২০১২-র মার্চের এক রাতের ঘটনা। এক সঙ্গে বেশি রোগী ঢুকে গেলে এখনও একই সমস্যায় পড়েন স্বাস্থ্যকর্মীরা। মূল ফটক ও ভবনের ছাদের মাথায় গ্লোসাইন বোর্ডে লেখা ‘মানবাজার গ্রামীণ হাসপাতাল’। সেই দিকে তাকিয়ে তাই এক স্বাস্থ্যকর্মীর সহাস্য মন্তব্য, “নামেই হাসপাতাল, পরিষেবার মান প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের থেকে বেশি কিছু নয়। দিন দিন চাপ বাড়লেও চিকিত্‌সক থেকে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে না।”

মানবাজার ব্লকের জনসংখ্যা ১ লক্ষ ৬০ হাজার। এর উপরে প্রতিদিন বহিরাগত লোকের সংখ্যা ধরলে প্রায় দু’লক্ষ মানুষের চিকিত্‌সা পরিষেবার ভার এই হাসপাতালের উপর। দক্ষিণ পুরুলিয়ার মূল বাজার মানবাজার। পুঞ্চা, বোরো, বান্দোয়ান, বরাবাজার ও কেন্দা থানার কিছু এলাকা থেকেও বাসিন্দারা এখানে চিকিত্‌সা করাতে আসেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতিদিন বহির্বিভাগে গড়ে ৯০০ জন রোগীর চিকিত্‌সা হয়। তাঁদের অপেক্ষার জন্য মাথার উপরে ছাউনি করা হয়েছিল। ছ’মাসের মধ্যে ফাইবারের সেই আচ্ছাদন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। রোগীদের আক্ষেপ, অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অপেক্ষমান রোগীদের জন্য সিমেন্টের বসার জায়গা করা হয়েছে। কিন্তু এখানে এত রোগীর ভিড় থাকলেও সেটুকু করা হয়নি। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছেন, এমন নজিরও আছে।

হাসপাতাল সূত্রে খবর, ১৯৮১ সালে তত্‌কালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ননী ভট্টাচার্য মানবাজার গ্রামীন হাসপাতালের উদ্বোধন করেন। অনুমোদিত শয্যার সংখ্যা ছিল ৩০টি। পরে প্রসূতি বিভাগের জন্য ১০টি শয্যা বেড়েছে। গত তিন দশকে জনসংখ্যা বেড়েছে অনেক। কিন্তু এই হাসপাতালের পরিকাঠামোর মান বাড়েনি। হাসপাতালে এখন হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক বিভাগে দু’জন চিকিত্‌সক রয়েছেন। আর একজন চিকিত্‌সক রয়েছেন শুধুমাত্র স্কুল পড়ুয়াদের স্বাস্থ্য দেখভাল করতে। এক্স-রে ইউনিটে দু’জন টেকনিশিয়ান থাকার কথা। রয়েছেন একজন। তিনি ছুটিতে গেলে বা অসুস্থ হয়ে পড়লে এক্স-রে বিভাগ বন্ধ থাকে। ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক অরুণাভ ঘোষ স্বীকার করে নিয়েছেন, “এই হাসপাতাল চালানোর জন্য পর্যাপ্ত চিকিত্‌সক, স্বাস্থ্যকর্মী, টেকনিশিয়ান, গ্রুপ ডি কর্মী নেই। জেলা স্বাস্থ্য দফতরে বহুবার এই সমস্যার কথা জানিয়েছি।”

মানবাজার গ্রামীন হাসপাতালের অধীনে কুদা ও পায়রাচালিতে দু’টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। পায়রাচালিতে ১০টি শয্যা রয়েছে। অর্ন্তবিভাগ চালানোর মতো পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র চিকিত্‌সক না থাকায় চালু করার ছ’মাসের মধ্যে অন্তর্বিভাগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে এই হাসপাতালের চাপ কমেনি। দেড় বছর আগে এই হাসপাতালে মিনি ব্লাড ব্যাঙ্ক গড়া হয়। জেলা সদর হাসপাতাল থেকে ১০ ইউনিট রক্ত আনা হয়েছিল। কিন্তু ইউনিট চালু করার মতো চিকিত্‌সক না থাকায় ওই ব্লাডব্যাঙ্ক চালু করা যায়নি। এই বর্ষাতেও সাপের ছোবলের প্রতিষেধক মিলছিল না। সম্প্রতি জেলা থেকে প্রতিষেধক পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তাও নেহাত কম।

হাসপাতালের সাফাই নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালের চারপাশে বর্জ্য ছড়িয়ে থাকে। স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, হাসপাতালের ভিতরে নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু বাইরের নোংরা আবর্জনা সাফাই করার মতো কর্মী নেই। ফলে হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে নোংরা জল মাড়িয়ে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা। হাসপাতালের সংক্রামক রোগীদের (আইসোলেশন) ওয়ার্ডে ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ায় ওই ওয়ার্ডে কাউকে রাখা হয় না। কয়েকমাস আগে এক্স-রে মেশিনের উপর জল চুঁইয়ে পড়ায় মেশিন বিকল হয়ে গিয়েছিল। রোগীদের আত্মীয়দের অপেক্ষার জন্য তৈরি করা প্রতীক্ষালয়টি মেরামতের অভাবে এখন তালাবন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে।

হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারপার্সন তথা মানবাজারের বিধায়ক সন্ধ্যারানি টুডু বলেন, “মানবাজার গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিত্‌সক, স্বাস্থ্যকর্মী-সহ বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। এ নিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের রাজ্যস্তরে কথা বলেছি।” তবে স্বাস্থ্যকর্মীদের একাংশের মত, জনপ্রতিধিরা একটু সচেষ্ট হলে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অনেক সমস্যাই কাটত। শুধু আশ্বাসে সমস্যা মেটে না।

বাসিন্দারাও ক্ষুদ্ধ। তাঁদের অভিযোগ, পুরুলিয়া শহর বেশ দূরে। তাই এই হাসপাতালের উপর প্রশাসন নজর দিলে অনেক মানুষের উপকার হত। পাশাপাশি পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে রোগী স্থানান্তর করাও কমত। হাসপাতালের হাল ফেরানোর দাবিতে তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় স্মারকলিপি দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি এই হাসপাতাল।

মানবাজার গ্রামীণ হাসপাতালের সমস্যার কথা মেনে নিয়ে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মানবেন্দ্র ঘোষ বলেন, “জেলার সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই চিকিত্‌সকের অভাব রয়েছে। তবু এর মধ্যে বাড়তি চিকিত্‌সক পাওয়া গেলে মানবাজারে অবশ্যই পাঠাব।”

সেই ভরসাই সম্বল মানবাজারবাসীর।

কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া’।
অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-১

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE