নিষ্ঠায় চলছে কালীপুজো।—নিজস্ব চিত্র।
তাঁদের কালীর পৌরহিত্যে কোনও ব্রাহ্মণই রাজি হননি। শেষমেশ স্বতন্ত্র জপমন্ত্রে মায়ের আরাধনা শুরু করেন নিজেরাই। এ ভাবেই শুরু করেছিল লাভপুরের মিরিটি বেনেপাড়া। ওই শতাব্দী প্রাচীন কালীপুজোর এমন বিদ্রোহী ধারা আজও বজায় রেখেছেন এলাকার ডোমেরা।
ওই এলাকায় প্রচলিত জনশ্রুতি হল, প্রায় তিনশো বছরেরও আগে পড়শিদের সঙ্গে বাইরের এক গ্রামে কালীপুজো দিতে গিয়ে উধাও হয়ে যান ডোম সম্প্রদায়ের এক বৃদ্ধা। এর পরেই একরাতে ‘ডোমবুড়ি’ নামে খ্যাত ওই বৃদ্ধার পরিবারের লোকেরা নাকি একটি স্বপ্নাদেশ পান। তাতে বলা হয়, অদূরে নুনদহ বিলের ধারে পাঁচ বোনে একত্রে অবস্থান করছেন মা কালী। তাদের এনে প্রতিষ্ঠা করে পুজোর ব্যবস্থা করলেই খোঁজ মিলবে ডোমবুড়ির। জনশ্রুতি অনুযায়ী, সকালেই পরিবারের লোকেরা সেখানে গিয়ে দেখেন একখণ্ড শিলা আঁকড়ে বসে রয়েছেন ডোমবুড়ি! মহা ধুমধাম করে ওই শিলাখণ্ড বাড়ি নিয়ে আসেন তাঁরা। শুরু হয় পুজোর তোড়জোড়। কিন্তু, সমস্যা দেখা দেয় পুরোহিত নিয়ে। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দারা বলেন, “সময় এলাকার ব্রাহ্মণেকা তথাকথিত অন্ত্যজদের পুজো করতে অস্বীকার করেন। আকাশ ভেঙে পড়ে উদ্যোক্তাদের মাথায়। তখন মুশকিল আসানে অবতীর্ণ হন স্বয়ং দেবীই!” কীভাবে? জনশ্রুতি বলছে, দেবীই স্বপ্নে জানিয়ে দেন পুরোহিতের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই মন্ত্রোচারণেরও। ভক্তি ভরে মায়ের চরণে যা মন চাই, তা বললেই হবে। সেই মতো পরিবারের সদস্যেরাই জপমন্ত্রে মায়ের আরাধনা শুরু করেন।
সেই ধারা আজও চলছে। পুরুষানুক্রমে ওই পুজো করছেন প্রতুলকৃষ্ণ দেবাংশী। তিনি বলেন, “বাপ-ঠাকুরদাদের কাছ থেকে শুনেছি ব্রাহ্মণ পুরোহিতেরা নাকি আমাদের পুজা করতে রাজি হননি। তা ছাড়া মা-ও হয়তো পরিবারের সদস্যের হাতেই পুজিত হতে চেয়েছিলেন। তাই আজও জপমন্ত্রে মায়ের পুজা করি।” অতীতের সেই ছুতমার্গ আজ আর অবশ্য নেই। আজ ডোমদের পুজো ওই গ্রামের তো বটেই, সামিল হন দূরদূরান্তের সব শ্রেণির মানুষজন। বধূ তৃপ্তি মণ্ডল, তনুশ্রী ঘোষদের কথায়, “মায়ের কোনও জাত হয় না। ছোট বড়ও নয়। বাড়ির অন্যান্য পুজোর মতোই বেনেপাড়ার কালীপুজোতে আমরাও সামিল হই।”
পুজোর মতোই মূর্তিতেও রয়েছে বিশেষত্ব। পরিবারের লোকেরা জানান, স্বপ্নাদেশ ছিল তাদের পাঁচ বোনেরই একত্রে মূর্তি গড়ে পুজো প্রচলন করতে হবে। সেই অনুযায়ী উদ্যোগ নিতেই লাভপুরের দ্বারোন্দা থেকে কয়েক জন গ্রামবাসী আবার তাঁদের কাছে এসে জানান, তাঁরা মায়ের দুই বোনকে নিয়ে গিয়ে পুজো প্রচলনের স্বপ্নাদেশ পেয়েছেন। একই দাবি নিয়ে এক মায়ের পুজো প্রচলনের জন্য আসেন লাভপুরেরই বাঁশপুরের বাসিন্দারা। তাঁরা শিলাখণ্ডের অংশ নিয়ে গিয়ে পুজো প্রচলন করেন। বাকি দুই বোনের মূর্তি একই বেদীতে গড়ে পুজো প্রচলন করেন বেনেপাড়ার ডোমেরা।
ওই মূর্তি কিন্তু প্রতি বছর বিসর্জন হয় না। ১২ বছর পরে পুরনো মূর্তি বিসর্জন দিয়ে প্রতিষ্ঠা হয় নতুন প্রতিমার। এ বারই পূর্ণ হচ্ছে ১২ বছর। বৃহস্পতিবার দুপুরে শেষ পুজোর পরে ভাসানে যাবে ১২ বছরের পুরনো মূর্তি। আর তার জায়গায় ফের ১২ বছরের জন্য পুজো শুরু হবে নতুন মূর্তির। ওই পরিবারের সাবিত্রী দেবাংশী, মমতা দেবাংশীরা বলেন, “এক মা-কে ভাসান দিয়ে আমরা আর এক মা-কে ঘরে তুলি। অভাব বোধ না হলেও বারো বছর ধরে নিত্যপুজো করা মা-কে ছাড়তে চোখের জল বাঁধ মানে না।”
স্থানীয় বাসিন্দা ৭৩ বছরের শিবপদ সরকার, ৯২ বছরের রোহিত দে-রা জানান, হয়তো সেই সময় উদ্যোক্তাদের প্রতি বছর মূর্তি গড়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তাই ওই প্রথা প্রচলিত হয়েছিল। আজ দিন বদলালেও সেই প্রাচীন প্রথা কিন্তু রয়ে গিয়েছে। কচিকাঁচারা অবশ্য অতশত কচকচানিতে মাথা ঘামাতে নারাজ।
সপ্তম শ্রেণির পলি সরকার, তৃতীয় শ্রেণির বর্ষা দেবাংশীরা বলছে, “কালীপুজোতেই মেলা বসে। পুজো এক দিনের হলেও মেলার রেশ থেকে যায় বেশ কিছু দিন। তাই পড়াশোনার চাপটাও কয়েক দিন কম থাকে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy